একুশের বঙ্গযুদ্ধে রামের ‘বিধাতা’ বামেরাই!

২০১৯ সালে বামফ্রন্ট যে ৭.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তা কি এবার আরও কমবে? নাকি একঝাঁক তরতাজা প্রার্থীদের তুলে এনে এ বার বড় কোনও চমক দেবে কাস্তে হাতুড়ি?

একুশের বঙ্গযুদ্ধে রামের 'বিধাতা' বামেরাই!
অলংকরণ- অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Apr 15, 2021 | 5:52 AM

অভিজিৎ ঘোষাল: গত কয়েক বছরে যে যে সমীকরণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই বামপন্থীদের রাতারাতি রামপন্থী হয়ে ওঠা। আক্ষরিক অর্থে হয়তো বামপন্থীরা বিজেপি হয়ে যাননি। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভোটের হার বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও বিজেপি যে দাপটের সঙ্গে ৪০ শতাংশ ভোট দখল করেছে, সেক্ষেত্রে বামপন্থীদের অবদান অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই।

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল ৩৪ টি আসন দখল করেছিল। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে সেই দল নেমে এল ২২ আসনে। লোকসভা ভোটের পর ফলাফল দেখে এর জন্য সরাসরি বামেদের দোষারোপ করেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বামেরা নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারেনি বলেই বিজেপির এই রমরমা, এমনটাই একাধিকবার দাবি করতে শোনা গিয়েছিল মমতাকে।

১৯৭০ সাল থেকে একুশ শতাব্দীর দোড়গোড়া পর্যন্ত মূলত দ্বিমুখী লড়াই দেখেছে বাংলা। যে লড়াইয়ে শাসকের আসনে ছিল বামেরা, এবং কংগ্রেস মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়ছিল প্রায় ২৫ বছর ধরে। কিন্তু, কংগ্রেসের হাত ধরে রেখে বাম দুর্গে ফাটল ধরাতে না পেরে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন মমতা। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বামেদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে তৃণমূল। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে একইভাবে বাম-কংগ্রেসকে ক্রমশ কোণঠাসা করে বাংলায় তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে বিজেপি। ‌

এক নজরে দেখে নেওয়া যাক সিপিআইএম এবং বামপন্থী দলগুলোর ভোট পরিসংখ্যান ২০১৪ সালের লোকসভা, ২০১৬-র বিধানসভায় কেমন ছিল এবং ২০১৯-এ এসে তা কোথায় দাঁড়ায়…

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএমের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে বিধানসভায় তা কিছুটা কমে হয় ১৯.৭ শতাংশ। কিন্তু ২০১৯ সালে রীতিমতো ধস নামে সিপিআইএমের ভোটবাক্সে। মাত্র ৬.৩ শতাংশ ভোট পায় বামফ্রন্ট শিবিরের এই প্রধান শরিক দল। বামফ্রন্টের আরেক শরিক সিপিআই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২.৩ শতাংশ, ২০১৬ বিধানসভায় ১.৪ শতাংশ এবং ২০১৯ লোকসভায় ০.৪ শতাংশে এগিয়ে থাকে।

এ বারে চলে আসা যাক আরএসপি-র কথায়। বামফ্রন্টের এই শরিকদল ২০১৪ সালে ২.৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১.৭ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ০.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। একই অবস্থা ফরওয়ার্ড ব্লকের। 2014 সালে যেখানে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ২.২ শতাংশ, ২০১৬ লোকসভা ভোটে তা বেড়ে হয় ২.৮ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তা কমে ০.৪ শতাংশে দাঁড়ায়।

ফলে যে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোটের হার ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ, সেটাই ২০১৬ বিধানসভায় কমে ২৫.৬১ শতাংশে এবং ২০১৯ সালের লোকসভায় কমে ৭.৫ শতাংশে চলে আসে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ঠিক যে হারে বামেদের ভোটবাক্স থেকে ভোট উধাও হতে শুরু করে, একই হারে বিজেপির ভোটবাক্স তা ভরিয়ে ফেলে।

২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে যেখানে বিজেপি’র প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ১৭ শতাংশ, সেটাই ২০১৬ বিধানসভায় কমে হয় ১০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে তা এক ধাক্কায় বেড়ে ৪০.৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। একই সঙ্গে ৪২ টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮ টি দখল করতে সক্ষম হয় বিজেপি। ঠিক এই জায়গাতেই নজর দিতে হচ্ছে, বিগত কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কেমন ফলাফল করেছিল এবং গত লোকসভায় তার কেমন ফলাফল ছিল সে দিকে।

পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৫১.৫ শতাংশ ভোট। কিন্তু একই বছর সেই রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার নেমে আসে ৩৩.৪ শতাংশে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে বিজেপি ভোট পেয়েছিল ২৭.৭ শতাংশ ভোট। একই বছর হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রাপ্ত ভোটের হার নেমে যায় ২৫.৮ শতাংশে। ওই বছর বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল হরিয়ানাতেও। যেখানে বিজেপি’র ঝুলিতে এসেছিল ৩৬.৫ শতাংশ ভোট। অথচ সেই হরিয়ানাতে কয়েক মাস আগে হওয়া লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৫৭.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

আরও পড়ুন: ভোটের প্রচার কি এ বার অনলাইনে? সিদ্ধান্ত নিতে সর্বদল বৈঠক ডাকল কমিশন

বিধানসভায় বিজেপির খারাপ পারফরম্যান্সের খতিয়ান এখানেই শেষ নয়। গত লোকসভায় দিল্লির সাতটি লোকসভা আসনেই জয়লাভ করেছিল বিজেপি। ভোট পেয়েছিল ৫৬.৭ শতাংশ। ২০২০ সালে এক বছর পর হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক একই জায়গায় ৩৮.৫ শতাংশ ভোট পায় বিজেপি। এই ক্ষেত্রে লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের মধ্যে ফারাক ছিল ১৮.২ শতাংশ। শেষ বিধানসভা নির্বাচন অর্থাৎ বিহারেও এই প্রবণতা কায়েম থাকতে দেখা গিয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভায় সেখানে বিজেপি ২৩.৬ শতাংশ ভোট পায়। কিন্তু ২০২০ সালের শেষভাগে বিধানসভা নির্বাচনে তা কমে হয় ১৯.৫ শতাংশ।

ফলে একটা বিষয় দিনের আলোর মত পরিষ্কার, গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে যতগুলি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, সেখানে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে লোকসভার তুলনায় খারাপ ফল করেছে বিজেপি। ফলে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়ে যে প্রশ্নটা সবচেয়ে বেশি করে প্রকট হচ্ছে তা হল, বিজেপি কি ২০১৯ সালের তুলনায় একুশের নির্বাচনে ভোটের হার বৃদ্ধি করতে পারবে?

এর সহজ এবং সরল উত্তর হল, বিজেপির ঝুলিতে এ বার কত শতাংশ ভোট আসবে তা পুরোটাই নির্ভর করবে এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট কেমন পারফর্ম করে তার উপর। ২০১৯ সালে বামফ্রন্ট যে ৭.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তা কি এবার আরও কমবে? নাকি একঝাঁক তরতাজা প্রার্থীদের তুলে এনে এ বার বড় কোনও চমক দেবে কাস্তে হাতুড়ি? আলিমুদ্দিনের প্রত্যাশা অবশ্য কিছুটা তেমনই। যে কারণে নন্দীগ্রাম থেকে জামুরিয়া, বালি থেকে ঝাড়গ্রাম, সবক্ষেত্রেই তরুণ-তরুণীদের প্রার্থী করা হয়েছে। যার মধ্যে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, ঐশী ঘোষ, পৃথা তা, সৃজন ভট্টাচার্য, দেবদূত ঘোষ, দীপ্সিতা ধর, প্রতিক উর রহমান, শতরূপ ঘোষ, মধুজা সেন রায় এবং দেবজ্যোতি দাসের মত প্রার্থীরা নজর কেড়েছেন।

আরও পড়ুন: তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতেই মৃত্যু ভাইয়ের, TV9 বাংলাকে বললেন আনন্দ বর্মণের দাদা