Bibhutibhushan Birthday: ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং ছিলেন অপূর্ব রায়’, লেখকের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জিতু কামালের

Jeetu Kamal: বিভূতিভূষণের জন্য তাঁর শ্রদ্ধার্থে কী লিখেছেন জিতু?

Bibhutibhushan Birthday: 'বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং ছিলেন অপূর্ব রায়', লেখকের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জিতু কামালের
বিভূতিভূষণের জন্মদিনে জিতুর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 12, 2022 | 2:07 PM

আজ সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন। আজ তাঁকে নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করলেন অভিনেতা জিতু কামাল। তিনি নিজেও অপরাজিত রায় চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনীক দত্ত পরিচালিত অপরাজিত ছবিতে। সেই ছবিটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির ঘটনাকে ঘিরে নির্মিত। বিভূতিভূষণের জন্য তাঁর শ্রদ্ধার্থে কী লিখেছেন জিতু?

“আজ বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য খুব‌ই বিশেষ একটা দিন। আজ অপুর জন্মদিন। অপুকে চেনেন তো? অপূর্ব রায়। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’র সেই ছেলেটা। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে যে খুঁটিয়ে দেখতে পারত। গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারত সামান্য একটা বিষাক্ত ফুলের সৌন্দর্য্যও। দারিদ্র্য যাকে অমলিন করতে পারেনি হাজার কষাঘাতেও।

অনেকেই হয়তো জানেন না, বিভূতিভূষণ স্বয়ং ছিলেন অপূর্ব রায়। বিভূতি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ‘অপরাজিত’ লিখেছেন, যা ছিল তাঁর নিজের জীবনের‌ই প্রতিচ্ছবি। সেখানে অপু ছিলেন তিনি নিজেই। অপর্ণা হয়েছিলেন তাঁর ক্ষনজন্মা স্ত্রী গৌরী। তাঁদের একবছরের ছোট্ট সংসারের সবটাই ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে তুলে ধরেছিলেন তিনি।

শুধু এই দুইটাই কেন? ওঁর সিংহভাগ উপন্যাস‌ই ওঁর বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতাগুলোর হুবহু কপি পেস্ট। জীবনের ছোটবড় কোনও ঘটনাকেই তিনি হারিয়ে যেতে দেননি। হারিয়ে যেতে দেননি তাঁর সঙ্গে পরিচয় হ‌ওয়া অদ্ভুত চরিত্রদের‌ও।‌ ওঁর আরেকটা বিখ্যাত উপন্যাস আদর্শ হিন্দু হোটেলের হাজারি ঠাকুর‌ও ছিলেন এক‌ই নামে একজন বাস্তব চরিত্র। তারানাথ তান্ত্রিক নামক তাঁর সৃষ্টি জনপ্রিয় চরিত্রটি খোদ তাঁর দ্বিতীয়পক্ষের শ্বশুরমশাই।

বিভূতি আমার জানা সবচেয়ে নরম হৃদয় লেখক ছিলেন। এতটা নরম হৃদয় খুব কম মানুষেরই হতে পারে। দয়ালু মানুষ মাত্রই নরম, তা কিন্তু নয়। ওরা জোর গলায় কথা বলতে পারে। কিন্তু বিভূতিভূষণ তা পারতেন না। যখন তাঁর উপন্যাসের কেউ সমালোচনা করত, উনি মাথা নিচু করে গ্রহণ করতেন। আবার যখন কেউ প্রশংসা করত, শিশুদের মতো খুশি হয়ে যেতেন। দিনলিপিতে লিখে রাখতেন। যেমনটা করত অপুও।

পত্রিকায় যখন তাঁর উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বের হচ্ছে, জাতপাত তখন তুঙ্গে। অনেকে অনেক ব্যাপারে প্রতিবাদ করে চিঠি দিয়েছেন। উনি সঙ্গে-সঙ্গে সেই অংশ বাদ দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন লিখিতভাবে। যেখানে তাঁর দোষ নেই, সেখানেও করেছেন‌‌। কখনও কোনও ঝামেলায় যাননি।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিভূতির কল্পলোকের দেবতা। রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা ছাড়া নিজের লেখা অসম্পূর্ণ মনে হত। তাই তাঁর উপন্যাসের কপি রবীন্দ্রনাথকে নিজেই পাঠিয়েছিলেন চিঠিসমেত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার প্রশংসা করেছেন। তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে আলাপ‌ও করেছেন। নিজের নতুন নাটক পড়ে শুনিয়ে বিভূতিভূষণের মতামত‌ও নিয়েছেন তিনি।

মজার ব্যাপার,সেই সময় থেকে প্রায় একশো বছর পার হয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে যুক্ত হয়েছে অগণিত সেরা উপন্যাস। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেরা পাঁচটি উপন্যাসের তালিকা করতে দিলে ‘পথের পাঁচালী’ অবশ্যই তার মধ্যে থাকবে। ‘পথের পাঁচালী’র মত উপন্যাস কেউ দ্বিতীয়টি লিখতে পারেনি,পারবেও না। বিভূতি এক ভিন্ন রুপে পৃথিবীকে দেখেছেন। তিনি অভাব জিনিসটাকে রীতিমত নগ্ন করে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। কিন্তু গ্রামবাংলার মানুষের আতিথেয়তা, যত্নের ক্রুটি সম্পর্কে কোথাও আভাস রাখেননি। তাঁর গল্পের চরিত্ররা সাতদিন না খেয়েও থেকেছেন। কিন্তু কোনও প্রতিবেশীর কাছে ধার চাইতে গেলে সেই প্রতিবেশী তাঁকে ফেরায়নি। কোনও বাড়ির দরজায় অচেনা আগুন্তক এসে দাঁড়ালে গৃহলক্ষ্মী তাঁকে না খাইয়ে তাড়িয়ে দেননি। কালকের নিশ্চয়তা যার নেই, সেও তাঁর পকেটের দুটি পয়সার একটি দিয়েছেন কোনও অভাবী বন্ধুকে। মানুষের নিষ্ঠুর দিক গোপন রেখে মানবতার প্রচার করে গেছেন বিভূতিভূষণ।

জনপ্রিয় হওয়ার পরেও এবং মনের চোখ দিয়ে প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য নিংড়ে নেওয়ার এত ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তিনি আফ্রিকায় বা জাহাজে জাহাজে শুধু ঘুরতে যেতেই চেয়েছেন। স্থায়ী হতে চেয়েছেন নিজ গন্ডগ্রাম পিতৃভূমিতেই। কারণ, ওখানকার প্রকৃতি তাঁর নিজস্ব। এই তাঁর শিকড়। এতটাই সাধারণ ছিলেন তিনি সারাজীবন।

নারীদের এক অন্য সম্মান দিয়েছেন বিভূতি তাঁর উপন্যাসে। তাঁর চোখে সব নারীই মা। নারীর এই মাতৃরূপ নিজের স্ত্রীর মধ্যেও দেখেছেন তিনি। ভালোবাসার মানুষের মধ্যেও দেখেছেন। যাঁদের কাছে মমতা পেয়েছেন, তাঁরাই তাঁর মাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। প্রথম জীবনে গৌরীকে বিয়ে করেছিলেন বিভূতি। মাত্র এক বছরের সংসারে পড়াশোনার জন্য অর্ধেকের বেশী সময় থেকেছেন কলকাতায়। শাশুড়ির অসুখের খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ছুটে গিয়ে দেখেন পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীর চিতা জ্বলছে। এই ঘটনায় অনেক বড় আঘাত তিনি পেয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। গৌরীদেবী মারা যান ১৯১৮ সালে। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে বিভূতি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি।

প্রেম এসেছিল, তাও ১৯৩৪ সালের পর। সুপ্রভা ও খুকু নামের দুই অনুরাগীর সংস্পর্শে এলেও তাঁদের‌ হারিয়েছেন দ্রুত‌ই। সুপ্রভা স্বল্প সময়ের জন্য খুব ভাল বন্ধু ও ভক্ত হয়েছিলেন। ঠিক যেমন অপুর ছিল লীলা। কিন্তু খুকুর প্রতি তিনি সত্যিকারের দুর্বল ছিলেন। তাঁর বিয়ে দিয়েছেন নিজ খরচে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে।

তারপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন ১৯৪০ সালে। সেই সংসার করেছেন মাত্র দশ বছর। তারপর মারা যান। যে মানুষ জীবনের এতটা সময় একা কাটিয়েছেন, কোন নারীর স্পর্শ না পেয়েও কী পরম মমতায় তাঁর উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলোর মনে ঢেলে দিয়েছেন দয়া,আবেগ,ভালোবাসা! ভাবতেই অবাক লাগে।

বিভূতির প্রতিটা উপন্যাস আমার মনে আলাদা ভাল লাগার সৃষ্টি করে। ‘আরণ্যক’-এর মতো এত প্রকৃতিপ্রেম, ‘অনুবর্তন’, ‘অশনি সংকেত’-এর মতো দারিদ্র্যের এমন নিষ্ঠুর বাস্তব রূপ। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর মত চমৎকার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যেমন লিখেছেন, ঠিক তেমন‌ই লিখেছেন ‘বিপিনের সংসার’, ‘দম্পতি’, ‘অথৈ জল’-এর মতো মানব মনের জটিল খেলার গল্প।

শুধুমাত্র ব‌ই পড়ে আর তথ্য সংগ্রহ করে আফ্রিকা না গিয়েও সেখানকার খুঁটিনাটি বর্ণনাসহ লিখেছেন ‘চাঁদের পাহাড়’। দুঃখ একটাই, যে মানুষটা প্রশংসা শুনতে এত ভালোবাসতেন, প্রশংসায় উৎসাহ পেতেন… লেখার সেই মানুষটা দুই বাংলায় তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে যেতে পারেননি। প্রশংসা জীবদ্দশাতে অবশ্যই পেয়েছেন, কিন্তু আরও যা পেয়েছেন সবটাই জেনে যাওয়া তাঁর প্রাপ্য ছিল। শুভ জন্মদিন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।”