Retinitis Pigmentosa: দ্রুত অন্ধ হচ্ছে সন্তানরা! সেরা স্মৃতি দিতে বিশ্বভ্রমণে কানাডার এই দম্পতি

ওই দম্পতির আতঙ্ক শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েই দেখা দিল ২০১৯ সালে। দুই ছেলেরও একই জেনেটিক অসুখ ধরা পড়ল! তাঁদের চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র লিও (৯)-এর এই ধরনের কোনও জিনগত সমস্যা নেই বলেই জানা গিয়েছে।

Retinitis Pigmentosa: দ্রুত অন্ধ হচ্ছে সন্তানরা! সেরা স্মৃতি দিতে বিশ্বভ্রমণে কানাডার এই দম্পতি
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 14, 2022 | 7:15 AM

মিয়ার বয়স যখন মাত্র ৩, ঠিক তখনই এডিথ লুমে এবং সেবাস্টিয়ান পেলেটিয়ে খেয়াল করলেন ভয়ঙ্কর সত্য! তাঁদের মেয়ে মিয়ার চোখে সম্ভবত কোনও সমস্যা রয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে একজন তাঁরা একাধিক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। মিয়া ছিল তাঁদের চার সন্তানের মধ্যে সবচাইতে বড়। শেষ পর্যন্ত এক বিশেষজ্ঞ জানালেন, মিয়া আসলে রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা রোগে আক্রান্ত। অসুখটি বিরল ধরনের জিনগত অসুখ। সময়ের সঙ্গে এই রোগে আক্রান্তর দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ নষ্ট হতে থাকে। ক্রমশ লুমে এবং পেলেটিয়ে, খেয়াল করলেন তাঁদের অপর দুই সন্তান কোলিঁ (৭) এবং লুহঁ (৫)-এর মধ্যেও একইরকম উপসর্গ দেখা দিয়েছে!

ওই দম্পতির আতঙ্ক শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েই দেখা দিল ২০১৯ সালে। দুই ছেলেরও একই জেনেটিক অসুখ ধরা পড়ল! তাঁদের চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র লিও (৯)-এর এই ধরনের কোনও জিনগত সমস্যা নেই বলেই জানা গিয়েছে।

‘ইচ্ছা থাকলেও সত্যিই কিছু করার নেই’— দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়েছেন লুমে। এই রোগের কোনও ওষুধ বা চিকিৎসা নেই। এমনকী রোগের অগ্রগতি মন্থর করার মতোও কোনও ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। ‘আমরা জানি না কত দ্রুত অসুখটি বৃদ্ধি পাবে। তবে মধ্য বয়সে পৌঁছে সম্ভবত সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলবে ওরা।’— জানিয়েছে লুমে।

অন্ধত্ব অনির্বায জেনে ওই দম্পতি বর্তমানে তাঁদের সন্তানদের নানা কাজে দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে মনোযোগী হয়েছেন যাতে ভবিষ্যতে তাদের কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে না হয়।

মিয়ার চিকিৎসক ওই দম্পতিকে বারবার মেয়ের দৃষ্টিগত স্মৃতি বৃদ্ধির দিকে জোর দিতে বলেছেন। একই কাজ করতে বলেছেন কোলিঁ এবং লুহঁ-এর ক্ষেত্রেও।

‘আমি ভাবলাম, তাহলে বইয়ে একটা হাতির ছবি না দেখিয়ে বরং সত্যিসত্যিই একটা হাতি ওকে দেখাতে নিয়ে যাব। বিভিন্ন দৃষ্টিগত সেরা স্মৃতি দিয়ে ওকে ভরিয়ে দেব।’ জানিয়েছেন মিয়ার মা লুমে। এরপরই তাঁরা বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা করেন।

১২ বছর ধরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ লুমে এবং পেলেটিয়ে। সন্তান নেওয়ার আগে বহু জায়গায় তাঁরা ঘুরে বেড়াতেন। তাঁরা স্থির করলেন তাঁদের সন্তানদের এবার বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।

বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত পেলেটিয়ে। কাজের চরম ব্যস্ততা ছেড়ে তিনি স্থির করেন সন্তানদের শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যই নয়, তার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচয় করাবেন।

সমস্ত জমানো অর্থ ভাঙানোর পালা শুরু হল। পেলেটিয়ের সংস্থাও তাকে এই ব্যাপারে খুব সাহায্য করে যা ওই দম্পতির কাছে অভাবনীয় ছিল।

দেরি না করে, ২০২০ সালের জুলাই মাসে ৬ জনের পরিবার বেরিয়ে পড়ে বিশ্বভ্রমণে! তাঁরা ঠিক করেন সমগ্র রাশিয়া ঘুরবেন স্থলপথে। সময় কাটাবেন চীনেও।

রোমাঞ্চকর যাত্রা

একাটা যাত্রার ইচ্ছে থাকলেও প্রথমবছরেই ধাক্কা এল। কারণ অতিমারীর দাপটে তখন বিদেশযাত্রায় পড়েছে রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। শেষ পর্যন্ত কানাডার শহর মন্ট্রিয়াল ছেড়ে ওরা বেরতে পারল ২০২২-এর মার্চে।

‘কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনাই ছিল না। আমরা শুধু জানতাম কোথায় যেতে চাই। গন্তব্যের দিকে এগতে এগতেই আমরা পরিকল্পনা করতাম।’

তবে বাড়ি ছেড়ে বেরনোর আগে কোন কোন জায়গা অবশ্যই তাঁরা যাবেন তার লিস্ট তৈরি করে নিয়েছিলেন। মিয়া চাইত ঘোড়ার পিঠে চড়ে এক দীর্ঘ যাত্রায় যেতে, অন্যদিকে লুহঁ চাইত উটের পিঠে চাপতে।

তারা নামিবিয়া দিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু করেন। সেখানে তাঁরা নিকট থেকে চাক্ষুষ করেন বন্য হাতি, জেব্রা, জিরাফ! এরপর পা রাখেন জামিবিয়া এবং তানজানিয়ায়। চলে যান তুরস্কে। সেখানে কাটিয়ে ফলেন একমাস। ওই পরিবার যাত্রা শুরু করেন মঙ্গোলিয়ার দিকে। তারপর ইন্দোনেশিয়া।

‘আমরা দেখার দিকে জোর দিচ্ছিলাম। আমরা ওদের চেনাচ্ছিলাম একাধিক প্রাণী আর উদ্ভিদ। আফ্রিকা, তুরস্কে অসাধারণ সব প্রাণীর দেখে আমার সন্তানেরা।’— বলেছেন লুমে।

‘এই ট্রিপ ওদের দৃষ্টিগত স্মৃতি বাড়ানোর সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতেও সাহায্য করবে বলে আমাদের মনে হয়েছিল।’

ইউ এস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ-এর একটি অংশ জাতীয় চক্ষু প্রতিষ্ঠানের তরফে জানানো হয়েছে, রেটিনাইটিস পিগমেনটোসা সাধারণত শৈশবেই শুরু হয়। বেশিরভাগ আক্রান্তই সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে।

শিক্ষা

‘যে কোনও ভ্রমণে সবসময় কিছু না কিছু শেখা যায়। তবে একটা সময় ক্লান্তি আসে, অস্বস্তি গ্রাস করে। হতাশ লাগে। এই ধরনের সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও চ্যালেঞ্জ। তাই ভ্রমণ সবসময় ভ্রামণিককে শিক্ষা দেয়।’

মিয়ার বয়স এখন ১২। ৭ বছর বয়স থেকে মিয়া তার চোখের অবস্থা সম্পর্কে জানে। কোলিঁ এবং লুহঁ ক্রমশ বুঝতে শিখছে আর কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে!

‘ছোটটা সবসময় প্রশ্ন করে যে মা অন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ কী। আমি কি গাড়ি চালাতে পারব?’— জানিয়েছেন লুমে।

‘ওর বয়স মাত্র পাঁচ। তবে ধীরে ধীরে ও বুঝছে যে কী হচ্ছে। ওর কাছে এই পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে ঘটছে। কিন্তু আমার কাছে সমগ্র ঘটনাটা হৃদয় ছিঁড়ে নেওয়ার মতো।’— বলেই চুপ করে যান লুমে।

লুমে এবং পেলেটিয়ে আশা করছেন আরও কিছু দেশ ঘুরে দেখার।

‘ওরা খুব কৌতূহলী। ওরা দ্রুত অন্য দেশের খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। আমি বেশ অবাকই হয়েছি।’— বলছেন লুমে।

‘আমরা সত্যিই জানতাম না ছেলেমেয়েদের কীভাবে অবাক করব বা আনন্দ দিতে পারব। তবে ওরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে আনন্দ খুঁজে নেয় যখন রাস্তায় একটা ছোট্ট কুকুর ছানাকে দেখে আদর করতে এগিয়ে যায়। এই মুহূর্তটাই ওদের জীবনের সেরা সময়।’

ওই পরিবার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে সামাজিক মাধ্যমে তাদের যাত্রাপথের ব্যাপারে সবিস্তারে বর্ণনা দিতে দিতেই যাচ্ছিলেন। লুমে বলছিলেন, রেটিনাইটিস পিগমেনটোসায় আক্রান্ত বহু ব্যক্তি ও বাচ্চার বাবা-মা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাদের যথাসম্ভব মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করে গিয়েছেন তাঁরা।

বস্তুতঃ, কুবেক-এর দৃষ্টিহীনদের জন্য তৈরি একটি স্কুলের এক শিক্ষক ফেসবুক থেকে দম্পতির যাত্রাপথের গল্প শোনাতেন ছাত্রদের।

‘প্রতি সপ্তাহে ফেসবুকে যা যা কিছু লিখতাম, ওই শিক্ষক পেজ খুলে পড়ে শোনাতেন তাঁর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের! বলতেন পোস্ট করা ছবির ব্যাপারেও।’ জানিয়েছেন লুমে।

‘কোনও না কোনওভাবে ওরাও আমাদের যাত্রার সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।’— গলা ধরে আসে লুমের।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

লুমে এবং পেলেটিয়ে জানিয়েছেন, সন্তানদের অসুখটি নিয়ে মাঝেমধ্যেই তাঁরা ভীত হয়ে পড়ে। কুঁকড়ে যান। তবে তাঁরা বর্তমানের ইতিবাচক বিষয়গুলির উপরেই দৃষ্টি নিবন্ধ করতে পছন্দ করেন।

‘আমরা জানি না কবে কীভাবে ওদের দৃষ্টি সম্পূর্ণ চলে যাবে। সুতরাং যতদিন চোখ আছে ততদিন ওরা জীবনকে উপভোগ করুক পূর্ণ দৃষ্টিতে।’— সেবাস্টিয়ান পেলেটিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন।

পরের বছর মার্চে ওই পরিবার বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপাতত তার চাইতে বেশি দূরে ওরা ভাবতে চাইছেন না। আসলে গত কয়েক মাসে ওই পরিবারের প্রতিটি সদস্য বুঝে গিয়েছেন জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড বেঁচে থাকার জন্য দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।

‘প্রাত্যহিক জীবনে ফিরে যাওয়ার পরেও এই বোধ একটা বড় পাওনা হয়ে থাকবে। এই ভ্রমণ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধনও দৃঢ় করেছে।’— বলেছেন লুমে।

লুমে এবং পেলেটিয়ের এখন একটাই আশা— মিয়া, কোলিঁ এবং লুহঁ যেন কখনওই দৃষ্টি না হারায়। ‘আশা করি আমরা কোনও না কোনও সমাধান খুঁজে বের করবই। তবে আমরা জানি হয়তো আমাদের আশা করা বৃথা। তবে সত্যিই যেদিন ঘটনাটা ঘটবে সেদিন আমাদের সন্তানেরা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তা আমরা নিশ্চিত করে যাব।’— বলতে বলতে কণ্ঠ ক্রমশ দৃঢ় হয়ে ওঠে লুমে আর পেলেটিয়ের।