অনলাইন ক্লাসের জন্য ল্যাপটপ নেই, মেলেনি বৃত্তির টাকাও, নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা ১৯ বছরের কিশোরীর

তেলঙ্গানার বাসিন্দা ঐশ্বর্য্য রেড্ডি দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজ ফর উমেনে গণিত নিয়ে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করছিলেন। লকডাউনের কারণে মার্চ মাস থেকেই পরিবারের সঙ্গেই থাকছিলেন তিনি।

অনলাইন ক্লাসের জন্য ল্যাপটপ নেই, মেলেনি বৃত্তির টাকাও, নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা ১৯ বছরের কিশোরীর
প্রতীকী চিত্র।
Follow Us:
| Updated on: Nov 27, 2020 | 2:32 PM

TV9 বাংলা ডিজিটাল: করোনা ভাইরাস (Coronavirus) ও লকডাউন (Lockdown)-র কারণে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে যে ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছে, তা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। পয়সার অভাবে আত্মহত্যা(Suicide)-র পথ বেছে নিলেন ১৯ বছরের এক কিশোরী। শেষ চিঠিতে ওই কিশোরীর বয়ান স্পষ্ট করে দিল প্যানডেমিকের কারণে যে আর্থিক অনটনের সৃষ্টি হয়েছে, তা কতটা ভয়াবহ।

তেলঙ্গানা (Telangana)-র বাসিন্দা ঐশ্বর্য্য রেড্ডি (Aishwarya Reddy) দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজ ফর উমেনে (Lady Shri Ram College for Women ) গণিত নিয়ে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করছিলেন। লকডাউনের কারণে মার্চ মাস থেকেই পরিবারের সঙ্গেই থাকছিলেন তিনি। পয়সার অভাবে অনলাইন ক্লাস (Online Class)-র জন্য ল্যাপটপ (Laptop) না থাকায় ও সরকারি বৃত্তির টাকা (Scholarship Money) না মেলায় পরিবারের উপর থেকে আর্থিক বোঝা কমাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি।

গত ৩ নভেম্বর রাতে আত্মহত্যা করার আগে সুইসাইড নোটে ঐশ্বর্য্য লেখেন,”আমার পরিবার আমার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেছে। আমি তাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছি। আমার লেখাপড়া বোঝায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমি পড়াশোনা ছাড়া বাঁচবো না। কয়েকদিন ধরে এই বিষয় নিয়ে ভেবেছি। আত্মহত্যা ছাড়া আমার কাছে অন্য কোনও পথ নেই।”

ঐশ্বর্য্যর মা-বাবা দিনমজুর। এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরোতো। লকডাউনের পর থেকে আরও আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েন তাঁরা। গত বছর ঐশ্বর্য্যকে কলেজে ভরতি করানোর জন্য বাড়ি বন্ধক রাখতেও বাধ্য হন তাঁরা। আর্থিক টানাটানির কারণে মাঝপথেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয় ঐশ্বর্য্যের ছোট বোন। তবে পরিবার ও বন্ধুদের মতে কেবল আর্থিক সংকট নয়, আত্মহত্যার পিছনে কিছু অংশে দায়ী কলেজ কর্তৃপক্ষও।

কয়েক মাস আগেই কলেজের তরফ থেকে পড়ুয়াদের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে হস্টেল ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও তাতে কর্ণপাত করেননি কলেজ কর্তৃপক্ষ। এই বিষয়ে এসএফআই আয়োজিত একটি সাংবাদিক বৈঠকে ঐশ্বর্য্যের মা বলেন, “কলেজের নির্দেশিকা পাওয়ার পর থেকেই ঐশ্বর্য্য আরও চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং প্রায়শই এই বিষয় নিয়ে কথা বলত। কোথা থেকে টাকা আসবে, এই প্রশ্নই বারবার ওর মুখে ঘুরত।”

কলেজের আশেপাশে থাকার মাসিক খরচ ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকা হওয়ায় তা কোনওমতেই ঐশ্বর্যে্যের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। এই বিষয়ে হস্টেলের ওয়ার্ডেনকে অনুরোধ করলেও থাকার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি বলেই জানান তাঁর বন্ধুরা।

শুধু থাকা নয়, লকডাউনের মাঝে অনলাইন ক্লাস করতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঐশ্বর্য্যকে। ল্যাপটপ না থাকায় ফোনের মাধ্যমেই অনলাইন ক্লাস করতে হচ্ছিল তাঁকে। লেডি শ্রীরাম কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে করা একটি সমীক্ষায় ঐশ্বর্য্য জানায়, দিনে আট ঘণ্টা অনলাইন ক্লাসের মধ্যে তিনঘণ্টারও কম সময় ক্লাসে যোগদান করতে পারতেন তিনি। ইন্টারনেট পরিষেবা ভাল না হওয়ায় তাঁকে অতিরিক্ত ডেটা প্যাকও কিনতে হত বলে জানিয়েছিলেন ঐশ্বর্য্য। সমীক্ষায় ঐশ্বর্য্যর বয়ান ছিল, “শিক্ষকরা ভালভাবেই পড়াচ্ছেন কিন্তু আমার ল্যাপটপ নেই এবং মোবাইলটিও ঠিকভাবে কাজ করছে না, ফলে কোনও প্রাকটিক্যাল কাজ করতে পারছি না।”

প্রতিদিনের উপস্থিতির হারেও কলেজের তরফ থেকে নজর রাখায় তা অতিরিক্ত বোঝায় পরিণত হয়েছিল ঐশ্বর্য্যের কাছে। তবে সবচেয়ে বড় মাথা ব্যাথার কারণ ছিল সরকারি বৃত্তির টাকা না মেলা। আর্থিক সঙ্গতিহীন মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত “ইন্সপায়ার” (INSPIRE) স্কলারশিপের ছাত্রী ছিলেন ঐশ্বর্য্য রেড্ডি। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের কাছ থেকে এক টাকাও বৃত্তি বাবদ টাকা পাননি ঐশ্বর্য্য, এমনটাই দাবি পরিবার ও বন্ধুদের।

আত্মহত্যার ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পরে ৮ নভেম্বর কলেজের তরফ থেকে একটি নির্দেশিকায় দুঃখপ্রকাশ করা হয়। তবে ঐশ্বর্য্যের আত্মহত্যার ঘটনা থেকে নিজেদের দায়ভার ঝেড়ে ফেলতে কলেজের তরফে বলা হয়, ঐশ্বর্য্য কখনওই নিজের বিভাগ বা কর্তৃপক্ষ কিংবা অধ্যক্ষের কাছে নিজের সমস্যার কথা বলে সাহায্য চাননি। ঐশ্বর্যের বন্ধু ও কলেজের ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের এই দাবিকে মিথ্যা বলে এবং জানায় তাঁরা বারংবার অধ্যক্ষ ও কর্মচারিদের কাছে ডিজিটাল মাধ্যমে পড়াশোনার সমস্যা নিয়ে হাজির হলেও একবারও নিজেদের মতামত বা প্রতিক্রিয়া জানাননি কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন: অতিমারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধির কথা মাথায় রেখে ধাবায় টিসু পেপার চেয়েছিলেন যুবক, দিতে হল প্রাণ!

ঐশ্বর্য্যের আকস্মিক আত্মহত্যার ঘটনায় হতবাক তাঁর সহপাঠীরা। তাঁরা বলেন,”ঐশ্বর্য্যের মৃত্যু সকলের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। আমরা যেমন ক্ষুব্ধ তেমনই শোকাতুরও। আমরা কলেজের অধ্যক্ষের কাছ থেকে এইরকম প্রতিক্রিয়া আশা করিনি। এই সপ্তাহেরও বেশি সময় লাগল কেন প্রতিক্রিয়া জানাতে?এর আগে তারা মুখ খোলেননি কেন?”

ঐশ্বর্য্যের মৃত্যুর সুবিচার চেয়ে ও বৃত্তির টাকা দ্রুত দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের বাইরে বিক্ষোভ দেখান। লেডি শ্রীরাম কলেজের পড়ুয়ারা ক্লাস বয়কটও করেন ঐশ্বর্য্যের প্রতি সুবিচারের দাবিতে।