টয়লেট পরিষ্কার থেকে বাজার করা! স্কুলে গেলে কী কী কাজ করতে হয় শিক্ষকদের!
মিড ডে মিলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের। ফলে, বাজার-হাট পর্যন্ত করতে হয় তাঁদের। পড়ুয়াদের জন্য বাজার করার পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করতে হয় যে তাঁদের খাবারের মান ঠিক থাকছে কি না। তার জন্য, রান্না যখন চাপানো হয়, তখন দাঁড়িয়ে তদারকি করতে হয় শিক্ষকদের।
স্কুলের সামনের মাঠটা হল চাষের জমি। লাঙল হাতে যাঁদের চাষ করতে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা শিক্ষক। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে, হাজার হাজার প্রার্থীকে পিছনে ফেলে চাকরি পেয়েছেন তাঁরা। চাষ করবেন বলে! পড়াশোনাই শুধু নয়, বাংলার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। তাতে ভুলচুক হলেও রেহাই নেই। সম্প্রতি বর্ধমানের গ্রামের রাস্তায় তো দেখা গেল নজিরবিহীন ছবি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করছেন! কার্যত সেলসম্যান-এর কায়দায় বোঝাচ্ছেন, সরকারি স্কুলে পড়লে কী কী সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। আর কী করতে হবে শিক্ষকদের?
সম্প্রতি বাংলা জুড়ে ট্যাব কেলেঙ্কারি সামনে আসে। তোলপাড় হয় গোটা রাজ্য। পরপর এফআইআর দায়ের হয় রাজ্যের একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। গর্জে ওঠে বাংলার শিক্ষকদের একটা বড় অংশ। আসলে ‘তরুণের স্বপ্ন’ নামে সরকারি যোজনার আওতায় স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য ট্যাব কেনার টাকা দেওয়া হয়। আর সেই স্কিমে পড়ুয়াদের নাম নথিভুক্ত করার কাজ করেন খোদ প্রধান শিক্ষকরা। অভিযোগ ওঠে, সেই নাম নথিভুক্ত করতে গিয়েই ভুল হয়েছে। তার জন্যই অন্য অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে ট্যাবের টাকা।
এখন শিক্ষকদের একাংশের প্রশ্ন, পড়ানো, পরীক্ষার খাতা দেখার বাইরে নাম আপলোড করার কাজ আমরা করব কেন? এই নিয়ে লড়াইও করছে শিক্ষক সংগঠনগুলি। শুধু একটা স্কিম নয়, ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজসাথী’র মতো প্রকল্প নিয়েও মাথাব্যথা সেই শিক্ষকদেরই।
বছর ১৫-২০ আগে ফিরে তাকালেই দেখা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মূল কাজ ছিল পড়ানো। ভরা ক্লাসরুমে সিলেবাস শেষ করানোর দায়িত্ব ছিল তাঁদের কাঁধে। নাম, তথ্য নথিভুক্ত করার কাজ মূলত করতেন ‘গ্রুপ সি’ কর্মী বা ক্লার্ক পোস্টে থাকা কর্মীরা। আর স্কুলের ঘণ্টা বাজানো বা গেট খোলার দায়িত্ব ছিল ‘গ্রুপ ডি’ কর্মীর কাঁধে। এখন সে সব দিন শেষ। স্কুলের গেটের তালা পর্যন্ত খুলতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।
‘বাজার-হাটও করতে হয় শিক্ষকদের’
কাটোয়ার হরিপুর মাঝিপাড়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৌশিক দে কয়েকদিন আগেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন ছাত্র খুঁজতে। তিনি বলছেন, ‘শিক্ষকদের এখন পড়ানোর বাইরে অনেক কাজ করতে হয়। ছাত্রদের বাড়ি থেকে ডেকেও আনতে হয়।’
তিনি জানান, মিড ডে মিলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষকদের। ফলে, বাজার-হাট পর্যন্ত করতে হয় তাঁদের। পড়ুয়াদের জন্য বাজার করার পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করতে হয় যে তাঁদের খাবারের মান ঠিক থাকছে কি না। তার জন্য, রান্না যখন চাপানো হয়, তখন দাঁড়িয়ে তদারকি করতে হয় শিক্ষকদের। স্কুল প্রাঙ্গন সাফাই করার কোনও লোক নেই। সেই কাজও করতে হয় শিক্ষকদের। অনেক স্কুলে সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার ফলে জঞ্জাল সরিয়ে সেই জায়গাগুলোকেও পরিষ্কার করতে হচ্ছে। ওই প্রধান শিক্ষক বলেন, “এসব দেখা তো আমাদের কথা নয়।”
নেই দারোয়ান, টয়লেট পরিষ্কার করাও শিক্ষকদের দায়িত্ব!
কম্পিউটার অপারেট করার কোনও লোক নেই। অথচ নতুন নিয়মে স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে রেজাল্ট, সব তথ্যই এখন কম্পিউটারে নথিভুক্ত করতে হয়। তাই সেই সব কাজও করতে হয় প্রধান শিক্ষক বা সহ শিক্ষক/ সহ শিক্ষিকাকে। বাগুইআটি অঞ্চলের এক নামী স্কুলের সহ শিক্ষিকা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলছেন, ‘আমাদের স্কুলে প্রায় ১৭০০ পড়ুয়া আছে। অথচ গ্রুপ ডি কর্মী মাত্র একজন রয়েছেন। গ্রুপ সি কর্মীও রয়েছেন একজনই। দারোয়ানের কোনও পোস্ট নেই। যিনি ছিলেন, তিনি অবসর নেওয়ার পর আর কাউকে নেওয়া হয়নি। ফলে, অনেক সময় গেটের তালাও খুলতে হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাকে।’ তাঁর কথায়, কাজ তো আর থেমে থাকতে পারে না। পর্যাপ্ত নিয়োগ না হওয়াটাই সবথেকে বড় সমস্যা। ওই স্কুলে টয়লেট পরিষ্কার করার কোনও লোক নেই।
শিক্ষিকা আরও জানিয়েছেন, ছাত্র ‘ধরতে’ শিক্ষকদের বেরতে না হলেও, প্যারাটিচারদের করতে হয় সেই কাজ। অনেকদিন ধরে কোনও পড়ুয়া স্কুলে না এলে, পরীক্ষা না দিলে, তার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করেন প্যারাটিচাররা।
‘প্রধান শিক্ষকদের দায়িত্বই কেউ নিতে চাইবে না আর’
এক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকই বলছেন, আর কেউ প্রধান শিক্ষক হতে চাইবেন না। তপন রামচন্দ্রপুর হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শুভজিৎ সাহা জানান, তাঁর স্কুলে নেই কোনও ক্লার্ক, নেই কোনও গ্রুপ ডি কর্মী। মোট ১৩টি শূন্যপদ রয়েছে। ৫০ শতাংশ শিক্ষক নেই স্কুলে। ফলে, কাজের বোঝা বেড়েই চলেছে।
শুভজিৎ সাহা বলছেন, “এমনিতেই নিয়োগ দুর্নীতির জন্য শিক্ষকদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে আবার জুড়ে গিয়েছে ট্যাবপ কেলেঙ্কারি। কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, সহ স্কলারশিপের সব টাকার লেনদেন আমাদের করতে হয়। আর তাতে ভুল হলেই অভিযোগ দায়ের হয়।” তাঁর দাবি, প্রধান শিক্ষকদের মানিটারি বেনিফিট বা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা খুবই কম, তাই আগামিদিনে কেউ প্রধান শিক্ষকের পদ নিতে চাইবেন কি না, তা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন শুভজিৎ সাহা।
কোন কোন স্কিমের জন্য কাজ করতে হয় শিক্ষকদের?
পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের জন্য ‘শিক্ষাশ্রী’, পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের জন্য ‘ঐক্যশ্রী’ স্কিমে টাকা দিতে হয়। এছাড়া নবম শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য রয়েছে ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্প, যার আওতায় সাইকেল দেওয়া হয়। এছাড়া এসসি, এসটি ও ওবিসি পড়ুয়াদের জন্য ধার্য করা আছে প্রি-ম্যাট্রিক স্কলারশিপ। সেখানে কাদের নাম নথিভুক্ত হবে, উপযুক্ত প্রমাণপত্র সংগ্রহ করা ভারও রয়েছে শিক্ষকদের। দশম শ্রেণির জন্য এনটিএসই (NTSE), অষ্টম শ্রেণির এনএমএমএসই (NMMSE) স্কলারশিপের টাকাও দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় শিক্ষকদেরই।