জেলে পার্থ কতক্ষণ? ED-CBI-এর চক্রব্যূহ কেটে পারবেন বেরিয়ে আসতে?
Recruitment Scam: যে পাঁচ জন এখনও জামিন পাননি, তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা ভারী পদ ছিল। তাঁরা ক্ষমতার সিঁড়ির অনেকটা ওপরের ধাপে ছিলেন। পার্থকে গ্রেফতার করার পর যেমন এই ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা সহজ হয়েছিল ইডি বা সিবিআই-এর পক্ষে, আবার পার্থকে ঘিরতে কুন্তল-শান্তনুরাই ছিল হাতিয়ার।
এক জুলাই মাসের সকালে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়ির দরজায় কলিং বেল বেজেছিল। হাজির হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকরা। শিক্ষা দফতর তখন আর তাঁর হাতে নেই। তবে তখনও তিনি রাজ্যের মন্ত্রী। মন্ত্রীর বাড়িতে ‘রেইড’ শুরু হওয়ায় সাধারণ মানুষের উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। সেই দিনটার পর থেকে রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যেন ‘ওটিটি সিরিজ’ চলেছে বাংলায়। কোনও এপিসোডে ‘টাকার পাহাড়’, আবার কোনও এপিসোডে মন্ত্রীর মেয়ের ‘চাকরি-কাহিনি’। কিন্তু যে ক্লাইম্যাক্সের জন্য অপেক্ষা ছিল, তার কী হল!
ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ED-CBI, কী হল শেষমেশ!
টাকা না দিলে চাকরি হবে না। এটা প্রায় প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলায়। প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল, সব ক্ষেত্রেই একই ছবি। কেউ কেউ সাহস করে আদালতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশেই ওই সব মামলায় ইডি ও সিবিআই তদন্তভার পায়।
দায়িত্ব পেয়ে একটুও দেরি করেনি কেন্দ্রীয় সংস্থা। শহর ছেড়ে গ্রাম, সর্বত্র চলে তল্লাশি। ইনভেস্টিগেশনের খাতায় উঠে আসে একের পর এক চমকে দেওয়ার মতো নাম। কেউ পরিচিত মুখ, কারও আবার নামই শোনেনি কেউ কখন। চিত্রনাট্যে চরিত্র, পার্শ্বচরিত্রের ছড়াছড়ি। সম্পত্তির বহরে এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। পার্থকে গ্রেফতার করার পর ইডি-র এক আইনজীবী বলেছিলেন, পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে রহস্য। একের পর এক ঘটনা তাঁর সেই কথাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে সেই রহস্যের কিণারায় পৌঁছনো কি সম্ভব হল?
ক্রমশ অতীত হচ্ছে নিয়োগ-মামলা?
জাল ফেলা শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে। কেউ কেউ বলেছিলেন জালে পড়বে আরও বড় মাছ। ‘বড় মাথা’ কিংবা ‘নাটের গুরু’ কে? কৌতূহল ছিল অনেকেরই। মাছ তো দূরের কথা, ২০২৪-এর মধ্যেই কি গুটিয়ে যাচ্ছে সেই জাল? প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। প্রশ্ন উঠছে সাম্প্রতিক কয়েকটি আদালতের রায়ে। একে একে জামিন পাচ্ছেন নিয়োগ মামলার অভিযুক্তরা।
কে কে জেলের বাইরে বেরলেন?
১৯ অগস্ট (২০২৩): জামিন পান নীলাদ্রি দাস। নাইসা কমিউনিকেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন নীলাদ্রি। গাজিয়াবাদ থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে এনেছিল সিবিআই।
১০ নভেম্বর (২০২৩): ‘মিডলম্যান’ প্রসন্ন রায় জামিন পেয়ে যান। তাঁর পেল্লায় বাড়ির ছবি চমকে দিয়েছিল অনেককেই। অভিযোগ ছিল, চাকরি প্রার্থীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতেন প্রসন্নই। যদিও পরে প্রসন্নকে আবারও গ্রেফতার করা হয় নিয়োগ সংক্রান্ত অন্য় একটি মামলায়।
১৬ ফেব্রুয়ারি (২০২৪): প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জামিন পান মানিক ভট্টাচার্যের পুত্র শৌভিক ভট্টাচার্য। অভিযোগ ছিল, নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে ঢুকেছিল তাঁর অ্যাকাউন্টেও।
১৪ মে (২০২৪): ১৩ মাসের জেলজীবন কাটিয়ে জামিন পান মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা। সিবিআই তল্লাশির সময় এই বিধায়ক কীভাবে তাঁর মোবাইল পুকুরে ছুড়ে ফেলেছিলেন, তা মনে আছে অনেকেরই। তাঁকে দুর্নীতির ‘মিডলম্যান’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন আধিকারিকরা।
১২ সেপ্টেম্বর (২০২৪): মুক্তি পেলেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। ২৩ মাস জেলে ছিলেন তিনি। নিয়োগে বেনিয়মে সরাসরি যুক্তি থাকার অভিযোগ তো ছিলই, মানিকের সম্পত্তি নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। তাঁর বিদেশে সম্পত্তি রয়েছে, এমন কথাও শোনা গিয়েছিল।
৮ অক্টোবর (২০২৪): একই সঙ্গে জামিন পান তাপস মণ্ডল এবং কৌশিক মাজি। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত ছিলেন এই তাপস মণ্ডল। আর কৌশিক মাজি ছিলেন ওএমআর প্রস্তুতকারী সংস্থা এসএন বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানির কর্তা।
২৫ নভেম্বর (২০২৪): পার্থর সঙ্গে একই দিনে গ্রেফতার হয়েছিলেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। জামিন পান তিনি। তাঁর দুটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছিল প্রায় ৫২ কোটি টাকা।
২৬ নভেম্বর (২০২৪): তৃণমূলের আর এক বহিষ্কৃত নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় জামিন পেয়ে যান। তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীদের একটি তালিকা উদ্ধার করেছিলেন ইডি আধিকারিকরা।
২৯ নভেম্বর (২০২৪): জেল থেকে বেরলেন কুন্তল ঘোষ। সেই কুন্তল, যিনি তৃণমূলের যুবনেতা ছিলেন। প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় যাঁর হাত অনেক লম্বা ছিল বলেই শোনা গিয়েছিল। এমনকী চাকরির কথা বলে টাকা নিতে ভুয়ো ওয়েবসাইটও নাকি বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
প্রায় ছাড়াই পেয়ে যাচ্ছিলেন ‘কালীঘাটের কাকু’
আসল নাম সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র। জেল থেকে এসএসকেএম ঘুরে আবার জেলে তিনি। কথায় কথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন নিয়োগ দুর্নীতির এই অভিযুক্ত। হেভিওয়েট লোকজনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথাও সামনে এসেছে আগেই। সেই সুজয়কৃষ্ণ শুক্রবার তো প্রায় জাল থেকে বেরিয়েই পড়েছিলেন। হাইকোর্টে জামিন পেয়ে যান তিনি।
কয়েক ঘণ্টা পরই বেরিয়ে যাওয়ার কথা, হঠাৎ আদালতে আবেদন করে প্রোডাকশন ওয়ারান্ট নিয়ে সুজয়কৃষ্ণকে কোনও ক্রমে আটকান সিবিআই আধিকারিকরা। এবার কি তবে নতুন মামলায় ফাঁসছেন তিনি?
এখনও শ্রীঘরে কারা?
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও জেলে রয়েছেন আরও কয়েকজন। বেশির ভাগ অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে গেলেও ছাড়া পাচ্ছেন না সুবীরেশ ভট্টাচার্য (উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য), কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্য়ায় (মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি), অশোক সাহা (এসএসসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান) ও শান্তিপ্রসাদ সিনহা (এসএসসি-র উপদেষ্টা কমিটির প্রাক্তন আহ্বায়ক)।
চক্রব্যূহের কেন্দ্রে পার্থ!
যে চারজন এখনও জামিন পাননি, তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা ভারী পদ ছিল। তাঁরা ক্ষমতার সিঁড়ির অনেকটা ওপরের ধাপে ছিলেন। পার্থকে গ্রেফতার করার পর যেমন এই ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা সহজ হয়েছিল ইডি বা সিবিআই-এর পক্ষে, আবার পার্থকে ঘিরতে কুন্তল-শান্তনুরাই ছিল হাতিয়ার। হেভিওয়েটদের প্রমাণ জোগাড় করতে কি বাকিদের প্রয়োজন ছিল? অর্থাৎ চক্রব্যূহের সবথেকে ভিতরের অলিন্দে পৌঁছনোর দরজা ছিলেন এরাই! তাহলে এবার কী হবে?
উল্লেখ্য, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে জামিন চাইতে গিয়ে ফিরতে হয়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। শীর্ষ আদালত বুঝিয়ে দিয়েছে, অন্যরা জামিন পেলেও, ভুললে চলবে না যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় একজন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন।
আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, বাকি যেই জামিন পান না কেন, পার্থর জামিন পাওয়া অত সহজ নয়। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, সুজয়কৃষ্ণ বা অন্যান্যরা কেউ প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন না, কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রশাসনের অংশ ছিলেন, তাই বাকিদের থেকে পার্থর ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। অর্থাৎ চক্রব্যূহের একটা একটা দরজা ভেঙে গেলেও ইডি বা সিবিআই এখন সেই অন্দর মহল সুরক্ষিত রেখেছে বলেই মনে করছেন তিনি। তবে প্রশ্ন হল, আর কতক্ষণ!