নন্দন পাল
গ্রাম-গঞ্জে সাপের কামড়ে প্রায় মৃত্যুর খবর শোনা যায়। সাপে কামড়ানো রোগীর একমাত্র চিকিৎসা অ্যান্টি-স্নেক ভেনম ইঞ্জেকশন। সাপে কামড়ানো রোগীদের চিকিৎসায় ট্যাবলেটের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে। দেশের চারটি মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় খাওয়ার ট্যাবলেট, ভ্যারেসপ্ল্যাডিব মিথাইলের মানবদেহে প্রয়োগের দ্বিতীয় দফার গবেষণার প্রক্রিয়া। সম্প্রতি ক্যানিংয়ের এক যুবককে বিষধর সাপে কামড়ায়। তাঁকে নিয়ে আসা হয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। তাঁর ওপরে প্রয়োগ করা হয় এই ট্যাবলেটের ২৫০ মিলিগ্রামের দুটি ট্যাবলেট। এভাবেই সাপের কামড়ের চিকিৎসায় এক নতুন অধ্যায়ের শুরু কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। এই ট্রায়ালের প্রথম পর্ব আমেরিকায় সাফল্যের সঙ্গে শেষ হওয়ার পর সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের (Central Drugs Standard Control Organisation) সাবজেক্ট এক্সপার্ট কমিটি ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এই ফেজ ২ ট্রায়ালটি করার অনুমোদন দেয়। এই মুহূর্তে মার্কিন মুলুকের ৪টি এবং ভারতের ৪টি হাসপাতালে মানবদেহে এই ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
এই গবেষণার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফেসিলিটেটর স্নেহেন্দু কোনার বলছেন, “কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের বিগত বছরের ডেটাবেসে দেখা গিয়েছে বিষধর বিগ ফোর সাপের কামড়ের বহু রোগী এই হাসপাতালে এসেছেন। তাই এই হাসপাতালকে গবেষণার কেন্দ্র হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে।”
দেশের যে চারটি গবেষণা কেন্দ্রে চলছে এই গবেষণা –
সাপের কামড়ের চিকিৎসা প্রোটোকল অনুযায়ী ব্যবহৃত হয় অ্যান্টি স্নেক ভেনম বা এএসভি। তার সঙ্গে এই ট্যাবলেটের ব্যবহার কেন প্রয়োজন জানালেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়। তিনি এই গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর। তিনি জানাচ্ছেন, “একসময়ে আমাদের রাজ্যের গবেষণাগারে তৈরি হত অ্যান্টি স্নেক ভেনম বা এএসভি। কিন্তু বর্তমানে অ্যান্টি স্নেক ভেনম তৈরি হয় দক্ষিণ ভারতে। দেশের এই দুই প্রান্তে যেহেতু সাপের প্রজাতি আলাদা তাই সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় প্রচুর পরিমাণে এএসভি দিয়েও অনেক সময়ে রোগীকে বাঁচানো যাচ্ছে না। এই দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালে এএসভির সঙ্গে দেওয়া হবে ওরাল এই ওষুধ।” ডাঃ মুখোপাধ্যায় বলছেন, এই গবেষণার শেষে দুটি বিষয়ের ওপরে তাঁদের নজর থাকবে। এক সাপে কামড়ের পর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ১০০ মিনিটের সময়কে বাড়াতে পারছে কি না এই ওষুধটি। আর দুই, হাসপাতালে সাপের কামড়ের চিকিৎসার সময়ে এএসভির ব্যবহারের পরিমাণ কমানো যাচ্ছে কি না এর ব্যবহারের ফলে।
কীভাবে রোগীদের দেওয়া হবে ভ্যারেসপ্ল্যাডিব মিথাইল ট্যাবলেট?
একটি সরকারি তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর ৩০০ রোগী সাপের কামড়ের জন্য ভর্তি হন। যদিও প্রকৃত সর্পাঘাতের সংখ্যা বছরে গড়ে তিন হাজারেরও বেশি। যেহেতু ৯০% রোগীই স্বাস্থ্য পরিষেবা না নিয়ে ওঝা বা গুনিনদের কাছে যান। তাই প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না । ২০০৯ সালে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দয়ালবন্ধু মজুমদার জেলা হাসপাতালে এমারজেন্সি সামলানোর সময়ে সামনে থেকে দেখেছেন সাপে কামড়ানো অসহায় রোগীদের। তিনি বলছেন, “সেই সময়ে আমাদের ডাক্তারদের মধ্যেও কনসেপ্ট ক্লিয়ার ছিল না। তারপর স্বাস্থ্য দফতর ও চিকিৎসকদের যৌথ উদ্যোগে ২০১২ সালে দেশের মধ্যে প্রথম সর্পাঘাতের চিকিৎসার প্রোটোকল তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গে। তারপর ২০১৬ এ সর্পাঘাতের চিকিৎসার ন্যাশনাল প্রোটোকল তৈরি হয়।”
ডেডলি ফোর –
গবেষক-প্রকৃতিবিদ ও চিকিৎসকদের মতে, দক্ষিণবঙ্গের যে চারটি সাপের কামড়ে বেশি মানুষ মারা যান তারা হল গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া ও কালাচ। উত্তরবঙ্গের ঘাতক প্রজাতির সাপগুলি হল গোখরো, কেউটে ও কৃষ্ণ কালাচ।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের রামমোহন ভবনের দুটি ওয়ার্ডে এখন প্রস্তুতি তুঙ্গে। মোট ৪০ জন ইচ্ছুক রোগীর ওপরে হবে এই গবেষণা। ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার আর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষদের জানানো হয়েছে, সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটলেই যেন তাদের দ্রুত নিয়ে আসা হয় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে।
ডাঃ দয়ালবন্ধু মজুমদার, ডাঃ পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় ও ট্রায়াল ফেসিলিটেটর স্নেহেন্দু কোনার
প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ডাঃ পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় টিভি নাইন বাংলা ডিজিটালকে বললেন ,”আপনাদের মারফত এই খবর আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই যে সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটলেই যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে নিয়ে আসুন আমদের কাছে। তাঁদের চিকিৎসায় আমরা টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন প্রস্তুত আছি।”