কেন কাজ করল না আরজি কর? স্টেথোস্কোপের চাপেও কীভাবে ফুটল জোড়াফুল!
RG Kar Effect on Election: এখনও পথে রয়েছেন ডাক্তারারাও। ধিকিধিকি করে হলেও জ্বলছে আরজি করের প্রতিবাদের আগুন। এখনও তিলোত্তমার সুবিচারের দাবিতে উঠছে স্লোগান। এদিকে আরজি করে ৯ অগস্টের ঘটনা দোলা লাগিয়েছিল গোটা দেশেই। দেশজোড়া আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন চিকিৎসকেরা।
আবাস থেকে একশো দিনের কাজ, নিয়োগ থেকে রেশন, তৃণমূল জমানায় ‘দুর্নীতির’ ফিরিস্তি দিতে দিতে মাঝে-মধ্যে যেন হাঁপিয়ে ওঠেন বিরোধী শিবিরের নেতারাও। শেষ বিধানসভা নির্বাচনের পর বাংলার শিক্ষক নিয়োগে পাহাড়-প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ নাড়িয়ে দেয় গোটা দেশকে। জেলে যেতে হয় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ঘাসফুল শিবিরের সামনের সারির নেতাদের। এখনও জেলেই রয়েছেন তাবড় তাবড় সব আমলারা। সঙ্গে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয় গরু পাচার, কয়লা পাচারের কাঁটা। তিহাড়ে ঠাঁই হয় অনুব্রত মণ্ডলদের। সঙ্গে রাজ্যজুড়ে বেড়ে চলা একের পর নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়ে আইন-শৃঙ্খলাও। বদলের রণহুঙ্কার দিতে দিতে মাঠে নামে বিজেপি। ফেরাতে হাল ফিরুক লাল বলতে বলতে বাম নেতারাও নেমে পড়েন মাঠে-ময়দানে। কিন্তু, বদল আর হল কই! তারপর বাংলায় ঘটে যায় নজিরবিহীন ঘটনা আরজি কর। মহিলা ডাক্তারের ধর্ষণ-খুন ঘটনায় শিহরিত হয়েছে গোটা দেশ। পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগড়ে রাস্তায় নেমেছিলেন হাজার হাজার ডাক্তার। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সব মহলের মানুষ। আমজনতা। বাংলার এমন কোনও মানুষ ছিলেন না, যাঁর কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসেনি, জাস্টিস ফর আরজি কর। এই আবহে অনেকেই মনে করেছিলেন, এখন যদি নির্বাচন হয়, তৃণমূল সরকার বদলে যাবে অনায়াসেই। ২০২৬-এ বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে অ্যাসিড টেস্ট হিসাবে ছয় ছ’টি কেন্দ্রে উপনির্বাচন হল। ছিঁটেফোটা দেখা গেল না আরজি করের প্রভাব। কেন কাজ করল না আরজি কর?
আরজি কর ফ্যাক্টর
শেষ লোকসভা ভোটের রণডঙ্কা যে সময় বাজছে ঠিক সেই সময়ই বাংলা একেবারে জাতীয় খবরের মানচিত্রে বড় জায়গা করে নিয়েছিল সন্দেশখালি। আগুন জ্বলে ওঠে বাংলা থেকে দিল্লির রাজপথেও। নেপথ্য ‘নায়ক’ শেখ শাহজাহান। লাগাতার নারী নির্যাতন, জমি দখলের ভূরি ভূরি অভিযোগের আবহে সন্দেশখালি যেন হয়ে ওঠে বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায় একটুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার। আর তা নিয়েই লোফালুফি শুরু করে দেয় বিরোধীরা। তেড়েফুঁড়ে মাঠে নামে বিজেপি। যদিও শেষবেলায় আচমকা স্টিং অপারেশনে উল্টে যায় পাশার দান। ভোটের রেজাল্ট বের হতে দেখা যায় পদ্ম শিবিরে অনেক আশা জাগিয়েও জিততে পারলেন না সন্দেশখালির ঘরের মেয়ে রেখা পাত্র। এবার উপনির্বাচনের ফলাফলেও যেন সেই ছবির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কেউ কেউ বলছেন, আশা জাগিয়েও শেষ বেলায় যেন কাজ করল না আরজি করের ডাক্তারদের ওষুধ।
এখনও পথে রয়েছেন ডাক্তারারাও। ধিকিধিকি করে হলেও জ্বলছে আরজি করের প্রতিবাদের আগুন। এখনও তিলোত্তমার সুবিচারের দাবিতে উঠছে স্লোগান। এদিকে আরজি করে ৯ অগস্টের ঘটনা দোলা লাগিয়েছিল গোটা দেশেই। দেশজোড়া আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদের ঢেউ পৌঁছেছিল কালীঘাট থেকে নবান্নেও। রাত দখল থেকে বিক্ষোভ-অবস্থান, কর্মবিরতি থেকে অনশন, জুনিয়র ডাক্তাদের প্রেসক্রিপশনে ছিল অনেক টোটকাই। প্রতিবাদের ঢেউ পৌঁছে গিয়েছিল রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মূল স্রোতের মিডিয়া, আরজি কর নিয়ে চলেছে তুমুল চাপানউতোর, ব্যাপক বিতর্ক। আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে হয় বিনীত গোয়েলকে। সরে যেতে হয় কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে। দুর্নীতির অভিযোগ গ্রেফতার হন আরজি করের ‘স্বনামধন্য’ অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। সিবিআই তদন্তভার হাতে নিতেই প্রশ্নের মুখে পড়ে সিবিআইয়ের ভূমিকা। গ্রেফতার হয়ে যান টালা থানার তৎকালীন ওসি। অনেকেই ভাবতেও শুরু করে দিয়েছিলেন আরজি কর বাণেই শেষবেলায় হয়তো বিদ্ধ হবে তৃণমূল। হাবে-ভাবে-মুখে বারবার সে কথা বলতে শোনা গিয়েছে বাম-বিজেপির নেতাদের। কিন্তু, আদতে খাতায় কলমে দেখা গেল উপনির্বাচনে সব আসনই গেল তৃণমূলের খাতায়।
কী বলছে তৃণমূল?
ভোটের ফল বের হতেই আরজি কর ইস্যুতেও বিরোধীদের তোপ দেগেছেন। তৃণমূল সাংসদ পার্থ ভৌমিক সাফ বললেন, “তিলোত্তমার জন্য আমরা মানসিকভাবে দুঃখিত। আমরা মনে করি এ ধরনের ঘটনা ঘটা বাঞ্চনীয় নয়। কিন্তু তার জন্য যাঁরা মমতাকে বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে আমরা তাঁদের ধিক্কার জানাই। আমার বোনের মৃত্যুকে নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে নৈহাটির মানুষ রায় দিয়েছে।” এদিকে উপনির্বাচনেও বিজেপির ভরাডুবির জন্য আবার ঘুরিয়ে নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলেছেন অর্জুন। তাঁর অভিযোগ, ৬ বছর একই পদে বহাল আছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই তৃণমূলের এই জয়জয়কার।
কী বলছে বিরোধীরা?
পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন নৈহাটির বিজেপির প্রার্থী রূপক মিত্র। তবে এখনই ছাড়ছেন না রাজনীতির ময়দান। এই ফলের পর ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনা ঘটলেই ফের তিনি প্রতিবাদ রাস্তায় নামবেন বলে জানিয়ে দিলেন। অন্যদিকে এবার আবার নৈহাটিতে সিপিআইএমএলের সঙ্গে জোট হয়েছিল বামফ্রন্টের। সেই সমঝোতাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। CPIML প্রার্থী দেবজ্যোতি মজুমদার এই রায় মেনে নিয়ে বলছেন, মানুষ যাকে চেয়েছে তাকেই জিতিয়েছে। তবে রাজনীতির ময়দান তিনিও ছাড়ছেন না!
রাজ্যে ছ’টি উপনির্বাচনের মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন হাড়োয়ার তৃণমূল প্রার্থী শেখ রবিউল ইসলাম। তিনি বাম সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী পিয়ারুল ইসলাম গাজিকে ১ লক্ষ ৩১ হাজার ২৮৪ ভোট ভোটে পরাজিত করলেন। ২০২১ সালে এই বিধানসভায় হাজি নুরুল ইসলামের জয়ের মার্জিন ছিল ৮০ হাজার ৯৭৮। ২০২৩ এর লোকসভা ভোটে বিধানসভা ভিত্তিক ফলে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের লিড ছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ১২১। দুই মার্জিনই ছাপিয়ে গেল উপনির্বাচনের ফলে। যা দেখে অনেকেই বলছেন রবিউল যেন কথা রাখলেন। বলেছিলেন বাবার মার্জিনকে ছাপিয়ে যাব। তারই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল বাস্তবের মাটিতে। তবে হারের পিছনে সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা বলছেন মাদারিহাটের বিজেপি প্রার্থী রাহুল লোহার। জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে গণনা কেন্দ্র ছাড়তে ছাড়তে বললেন, সাংগঠনিক দুর্বলতায় হেরেছি। রায় মাথা পেতে নিচ্ছি। মাদারিহাট হারার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরক মন্তব্য করতে দেখা গিয়েছে জন বার্লাকে। তাঁর দাবি, এই হার শুধুমাত্র অহঙ্কারের জন্য। সবটাই ওয়ান ম্যান আর্মি ডিসিশন। কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তার ফল ভুগতে হচ্ছে। যদিও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের মত আলাদা। তিনি বললেন, “আমাদের লক্ষ্য ২০২৬। উপনির্বাচনে ভোট করতে দেয় না। ভোট করতে দিলে মানুষ ভারতীয় জনতা পার্টিকে সমর্থন করবে।” তৃণমূলকে খোঁচা দিতে ছাড়েননি কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীও। ফলের প্রসঙ্গ উঠতেই বলেন, “এই ফলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভোট হয়েছে বলে মনে হয় না।”
ডাক্তারদের ‘অরাজনৈতিক’ আন্দোলন মাইলেজ দিল তৃণমূলকে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোটের ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায় উপনির্বাচনে সিংহভাগ আসনেই ফের নিজেদের খাতাতেই রাখে শাসকদলগুলি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে হাজার চাপানউতোরের মধ্যে সেই ট্রেন্ডই বজায় থেকেছে। খুব একটা কাজ করেনি আরজি কর ফ্যাক্টর। এমনকী আরজি করের প্রতিবাদকে ‘শহুরে আন্দোলন’ নাম দিয়ে চর্চা চলেছে নানা মহলে। তাই তার ছাপ তালডাংরা থেকে মেদিনীপুরের মতো আসনগুলিতে খুব একটা পড়েনি বলে মত অনেকের। একইসঙ্গে, শুরু থেকেই ডাক্তাররা বারবার বলেছেন তাঁদের এই আন্দোলন পুরোপুরি ‘অরাজনৈতিক’। তৃণমূল বারবার নকশাল-সিপিএম যোগের কথা বললেও তা ফুৎকারে উড়িয়ে দেন অনিকেত-দেবাশিসরা। তাঁদের আন্দোলনে দাঁত ফোটাতে গিয়ে বারেবারে বেগ পেতে হয়েছে সিপিএম-বিজেপির মতো দলগুলিকেও। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পালদের শুনতে হয়েছিল গো ব্যাক স্লোগান। আক্ষেপের সুর শোনা গিয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর গলাতেও। বিরোধী দলনেতা তো শেষ পর্যন্ত বলেই দিয়েছিলেন, “বাম এবং অতি বামেরা এই আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে।” অধীর চৌধুরী আবার বলছেন, ফলের সঙ্গে আরজি করের কোনও সম্পর্ক নেই।
যদিও ভিন্ন কথা জুনিয়র ডাক্তারদের গলায়। শুরু থেকেই আরজি কর আন্দোলনের বড় মুখ ছিলেন অনিকেত মাহাতো। তিনি বলছেন, “আমাদের আন্দোলন-দাবির যে সুর ছিল তার সঙ্গে রাজনীতির মূল ধারার অনেক রাজনৈতিক দলই সুর মেলাতে পারেনি। ভোটের ময়দানের রাজনীতি করতে, ফায়দা নিতে আমরা আন্দোলন করতে আসিনি। কে কত ভোটে জিতল, কে কীভাবে কোন এলাকা দখল করল তা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা কোনও উপনির্বাচনের ফলাফলের উপর নির্ভর করে বলে আমরা মনে করি না।”