Ganesh Festival 2022: মোবাইলে জমছে ধুলো! গণেশ আরতির গানে ‘ঘূমত’ বাদ্য বাজিয়ে আত্মহারা এই গ্রামের শিশুরা

Ghumat Arati: নিশনীতেশ নায়েকের বয়স মাত্র ২ বছর। অথচ তার ছোট্ট কাঁধে এখন মস্ত দায়িত্ব। তাকে প্রতিদিন বিকেলে যেতে হয় গ্রামের মন্দিরে। সেখানে আরও কিছু বাচ্চার সঙ্গে সমবেতভাবে সে শিখে নেয় ঘূমত বাদ্য!

Ganesh Festival 2022: মোবাইলে জমছে ধুলো! গণেশ আরতির গানে 'ঘূমত' বাদ্য বাজিয়ে আত্মহারা এই গ্রামের শিশুরা
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 04, 2022 | 4:38 PM

দক্ষিণ গোয়ার শিরোদিয়া জেলার তারাভালেম গ্রামে মোবাইল টাওয়ার নিশ্চিতভাবে আছে। রয়েছে সীমাহীন ইন্টারনেট সংযোগ। ইন্টারনেট মানেই আজকাল বাচ্চাদের কাছে তা পূর্ণ বিনোদনের হট্টমেলা। ইউটিউব, গেম-এর কৃত্রিম দুনিয়ায় প্রবেশের অবাধ ছাড়পত্র। এই কারণেই আধুনিক যুগে দেখা যায়, মুখে বুলি ফুটুক আর নাই ফুটুক, বাচ্চারা মোবাইলের ব্যবহারের আদব আয়ত্ত করে ফেলে। এই চিত্র শুধু শহর নয়, দেশের প্রতিটি গ্রামেও একই দৃশ্য। বাচ্চার কান্না থামানো হোক বা তার বায়না মেটানো— সব ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের কাছে একটাই সমাধান মোবাইল। অথচ প্রযুক্তির হাটবাজার থেকে অনেক দূরে, আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে সংযোগ রেখেও তারাভালেম গ্রাম হয়ে উঠেছে ভিন্ন এবং গর্বের একখানি জনপদ। সেখানে বাচ্চারা বিনোদনের জন্য হাতে মোবাইল তুলে নেয় না। বরং গেয়ে ওঠে ঘূমত আরতির আনন্দ সংগীত! প্রকৃতির ছন্দে বাজায় ঘূমত বাদ্যযন্ত্র। আকাশ বাকাশ মুখরিত হয়ে ওঠে ঘূমতের আদিম বোলে!

ঘূমত আরতি একধরনের ভক্তিমূলক লোকসংগীত। গণেশ পূজার উৎসবে ১০ দিন ধরে ঘূমত বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গাওয়া হয় এই গান। গোয়ার জনজাতির শিকড়ের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ঘূমতের বিকল্পহীন শিকড়। অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই লোকসঙ্গীতের চর্চার বীজ শিশুদের বুকে বুনে দেওয়ার তারাভালেমের বরিষ্ঠ অধিবাসীরা। নিশনীতেশ নায়েকের বয়স মাত্র ২ বছর। অথচ তার ছোট্ট কাঁধে এখন মস্ত দায়িত্ব। তাকে প্রতিদিন বিকেলে যেতে হয় গ্রামের মন্দিরে। সেখানে আরও কিছু বাচ্চার সঙ্গে সমবেতভাবে সে শিখে নেয় ঘূমত বাদ্য! তাল দেওয়ার এই যন্ত্র তৈরি হয় মাটির কলস এবং ছাগলের চামড়া দিয়ে। কলসের প্রশস্ত দিকে বাঁধা হয় চামড়া। সরু মুখটি থাকে খোলা।

গ্রামের ৩০ বছর (প্রায়) বর্ষীয় এক যুবক সঙ্গীতজ্ঞ এবং বাদ্যযন্ত্র বিশারদ রাহুল কৃষ্ণানন্দ ললিতকর স্বষ্কন্ধে তুলে নিয়েছেন আগামী প্রজন্মের সঙ্গে প্রাচীন ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের ভার। তিনিই খুঁজে বের করছেন প্রতিটি শিশুর অন্তরে লুকিয়ে থাকা শিল্পীসত্তা! ময়ূর নায়েক নামে এক গ্রামবাসী জানিয়েছেন, কীভাবে অধিবাসীদের সঙ্গে মিলিতভাবে ললিতকর সাহেব শিশুদের মধ্যে সঙ্গীত নিয়ে আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছেন! তারাভালেমের শিশুরা এখন আর মোবাইলে রিল তৈরি করে না বা খেলে না গেমস! মোবাইল ছেড়ে তারা হাতে তুলে নিয়েছে ঘূমত বাদ্যযন্ত্র। ময়ূর নায়েকের ভাগ্নে নিশই হল এই সঙ্গীত শিক্ষণ দলের সবচাইতে খুদে সদস্য।

‘নিশের বয়স মাত্র ২ বছর। বাড়িতে আমি যখন ঘূমতের রেওয়াজ করতাম তখন থেকেই ওর মধ্যে বাদ্যযন্ত্রটির প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তাই আমরা ওকে ললিতকর সাহেবের এই বিশেষ ক্লাসের সঙ্গে পরিচিত করানোর সিদ্ধান্ত নিই। এখন ও প্রতিদিন ক্লাসে আসে।— জানিয়েছেন ময়ূরবাবু। তারাভালেমের রত্নদীপ সাংস্কৃতিক এবং ক্রীড়া সংঘ ললিতকর সাহেবের এই প্রচেষ্টায় সবধরনের সহায়তা প্রদান করছে। ললিতকর সাহেব জানিয়েছেন তিনিও ছোট থেকেই অন্য শিশুদের সঙ্গে ঘূমত সঙ্গীত আরতি গাইতেন। তবে গত একদশক ধরে এই ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ‘দশ বছর আগে, আমাদের একটি কমবয়সিদের দল ছিল। দলটি ঘূমত আরতির নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। অথচ ধীরে ধীরে দলটির সদস্যরা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাঁচ-ছয় বছর পরে দেখা যায়, গ্রামের কোনও শিশুর মধ্যেই ঘূমত নিয়ে কোনও নেই! তারা কেউই আর ঘূমত শিখতে চাইত না।’

সম্প্রতি দীপক সাবরদেকার নামে এক গ্রামবাসী ললিতকর সাহেবের কাছে আসেন ও পুনরায় শিশুদের মধ্যে ঘূমত আরতির প্রশিক্ষণ শুরু করার প্রস্তাব রাখেন। বাকি গ্রামবাসীরাও ওই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। ‘জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আমি শিশুদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি।’— জানিয়েছেন ললিতকর। প্রথমদিকে, মাত্র ৭ থেকে ৮ জন বাচ্চা শিখতে আসে। ধীরে ধীরে শিশুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই মুহূর্তে প্রায় ২৪টি বাচ্চা ললিতকর সাহেবের কাছে শিখছে ঘূমত আরতি। এই ২৪টি বাচ্চার মধ্যে ১২জন ছেলে ও ১২জন মেয়ে! ‘আমরা মেয়েদেরও এই দলে যোগ দিতে উৎসাহ দিই।’— জানিয়েছেন জনৈক গ্রামবাসী। মানিলা শিরোদকর, তারাভেলাম গ্রামের ভারতনাট্যম শিক্ষিকা জানিয়েছেন তাঁর ১৫ বছরের কিশোর সন্তানও এই দলের সদস্য এবং সে ঘূমত বাজানো শিখছে। এই দৃশ্য তাঁর কাছে অত্যন্ত সন্তোষজনক বলে জানিয়েছেন মানিলা। ‘ও সারাদিন ধরে বিকেল হওয়ার অপেক্ষা করে। কারণ ও জানে সূর্যের আলো কমতে শুরু করা মানেই ওর ঘূমতের ক্লাস শুরু সময় আরও কাছে চলে আসছে!’ বলছেন মানিলা।

আর মোবাইল? ‘সেল ফোন এখন অতীতকালের বিষয় হয়ে গিয়েছে ওদের কাছে।’ শিরোদর উত্তর দিয়েছেন! ললিতকর সাহেব বলেছেন, শিশুদের বাদ্যযন্ত্র শেখানো কোনও সহজ বিষয় নয়। ‘একেবারে হাতেখড়ি থেকে শুরু হয়! তবে একবার ছন্দে চলে এলে সঙ্গীতের নেশাই ওদের টেনে নিয়ে যায় বিভোর স্রোতে’— ছাত্র-ছাত্রীদের কথা বলতে বলতে চোখ চকচক করে ওঠে ললিতকর সাহেবের। তিনি আরও বলেন, শিশুদের ভজনও শেখানো হবে।

‘এই দলটি গোয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত ঘূমত আরতি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। এমনকী নানা মন্দিরে প্রদর্শন করবে ওদের কুশলতা।’— বলতে বলতে গর্বে আর উত্তেজনায় গলা কেঁপে যায় তরুণ শিক্ষকের। আনমনা হয়ে যান আকাশে দিকে তাকিয়ে। তাঁর চোখে এখন অনেক স্বপ্ন— এই স্বপ্ন তাঁর একার নয়, একটা জাতির পুনরা সদর্প উপস্থিতি জানান দেওয়ার স্বপ্ন।

তথ্য সৌজন্য – ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস