Lalit Modi: মাদক বিক্রি, অপহরণ, একাধিকবার জেল যাত্রা; বিতর্কিত ব্যবসায়ী ললিতের আইপিএলের রাজা হওয়ার আখ্যান
এক শহরের সঙ্গে অন্য শহরের ব্যাটে-বলে লড়াই। আপাত সাধারণ এই কনসেপ্ট যে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁতে পারে, তা ভাবতে পেরেছিলেন একজনই। রাজস্থান ক্রিকেট সংস্থার কর্তা, ব্যবসায়ী ললিত মোদী (Lalit Modi)। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়র লিগের জনক। ক্রিকেট সর্বস্ব এই দেশে বাইশ গজের লড়াইয়ের সঙ্গে ব্যবসার মিশেলে যা তৈরি হল তার পোশাকি নাম আইপিএল। ডাক নাম 'বিলিয়ন ডলার বেবি'। মনোরঞ্জন কা বাপ।
কলকাতা: এক শহরের সঙ্গে অন্য শহরের ব্যাটে-বলে লড়াই। আপাত সাধারণ এই কনসেপ্ট যে জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁতে পারে, তা ভাবতে পেরেছিলেন একজনই। রাজস্থান ক্রিকেট সংস্থার কর্তা, ব্যবসায়ী ললিত মোদী (Lalit Modi)। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়র লিগের জনক। ক্রিকেট সর্বস্ব এই দেশে বাইশ গজের লড়াইয়ের সঙ্গে ব্যবসার মিশেলে যা তৈরি হল তার পোশাকি নাম আইপিএল। ডাক নাম ‘বিলিয়ন ডলার বেবি’। মনোরঞ্জন কা বাপ। ভারতীয় ক্রিকেটে লাগল গ্ল্যামারের ‘তড়কা’। গ্যালারিতে নিত্যদিন কোনও না কোনও সেলিব্রিটির মুখ। ক্রিকেটের ময়দানে স্বল্পবসনা চিয়ারলিডার্সদের প্রবেশ। চার-ছয়ের বন্যা ও উইকেট পতনে সুন্দরীদের কোমর দোলানো। ভারতীয় ক্রিকেটের সংস্কৃতিতে জাঁকজমকের আমদানি তাঁরই ভাবনার ফল। ফুলে ফেঁপে ওঠে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। বিসিসিআই-য়ের বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড হতে ললিত মোদীর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ললিতের সেদিনের ‘বিলিয়ন ডলার বেবি’ আজ ১৫ বছরের ঝকঝকে টিনএজার। জনপ্রিয়তা বেড়ে দ্বিগুণ। গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে মেয়েদের আইপিএলের ভাবনা। আগামী মরসুমের জন্য রেকর্ড অর্থে আইপিএলের সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি করে হইচই ফেলে দিয়েছে ভারতীয় বোর্ড। এত হইচইয়ের মাঝে কোথায় আইপিএলের বিতর্কিত জনক? ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কলঙ্ক গায়ে নিয়ে বহুদিন হল লন্ডন নিবাসী। আইপিএলের আবহে মাঝে মধ্যে এক আধবার নাম শোনা গেলেও তার স্থায়ীত্ব বেশি নয়। তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ফের শিরোনামে ললিত মোদী। নেহাতই ব্যক্তিগত জীবনের জন্য। ৫৮ বছরের বিপত্নিক এই ব্যবসায়ী চুটিয়ে ডেট করছেন বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেনের সঙ্গে।
শহর গড়েছিল পূর্বসূরীরা
দিল্লির এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী পরিবারের জন্ম। বাবা ছিলেন কৃষ্ণ কুমার মোদী। দাদু রাজ বাহাদুর গুজরমল মোদী। গাজিয়াবাদের কাছে মোদিনগর নামে একটি শহরের প্রতিষ্ঠাতা গুজরমল মোদি। যাই হোক, পড়াশোনায় কোনও কালেই মেধাবী ছিলেন না ললিত। কিন্তু ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল প্রবল। কমজোর স্টুটেন্ড। কখনও সখনও স্কুলের মুখ দেখতেন। কোনওক্রমে স্কুলের গণ্ডি পার করে উচ্চশিক্ষার জন্য জেদ করে আমেরিকার ডারহামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন নেন।
ললিতের জেল যাত্রা
ললিত মোদীর সঙ্গে বিতর্কের যোগাযোগ শুরু ১৯৮৫ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক বিক্রির অভিযোগে সেবার প্রথম জেল যাত্রা। ধারালো অস্ত্র নিয়ে অন্যের উপর হামলার জেরেও জেল যেতে হয়েছে। এমনকী কিডন্যাপিংয়ের অভিযোগও ওঠে। দু’বছরের কারাবাসে দণ্ডিত হন। তবে পরে সাজা কমে যায়।
পালিয়ে এলেন ভারতে
জেল খাটার পর ভারতে ফেরার জন্য আদালতের দ্বরস্থ হন। ততদিনে স্নাতকের গণ্ডি পার করেছেন। অনুমতি মিলতেই দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসায় লেগে পড়েন। যদিও বাবা ব্যবসার কোনও প্রজেক্টই ললিতের মনমতো ছিল না। সেসব ছেড়েছুড়ে নিজের ভাগ্য অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে বড় তামাক কোম্পানি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে ছিলেন। তবে ক্রীড়া এবং বিনোদন জগত বরাবরই টানত তাঁকে। ১৯৯১ সালে মায়ের ডিভোর্সি বন্ধু মিনলকে বিয়ে করেন।
ভারতীয় ক্রিকেটে ললিতের প্রবেশ
ক্রিকেট প্রশাসনে ঢোকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বহুদিন ধরে। ১৯৯৯ সালে প্রথমবার চেষ্টা সফল হয়। হিমাচল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন। গরমের সময় ক্রিকেট খেলতে যাতে অসুবিধে না হয়, সেরকম একটি স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনা করেন। এর বাস্তবায়নের তোড়জোড়ও শুরু করে দেন। মাথার মধ্যে ক্রিকেট লিগ তৈরির ভাবনাটা ঘুরছিল অনেকদিন ধরেই। ১৯৯৬ সালে বিসিসিআইয়ের কাছে ৫০ ওভারের ক্রিকেট লিগ শুরু করার প্রস্তাব রাখেন। যাতে মোটেও আমল দেননি তৎকালীন বোর্ড প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে ললিতের প্রবেশ
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডে পা রাখার চেষ্টা সফল হয় ২০০৪ সালে। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। শোনা যায়, ললিতকে রাজস্থান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পদে বসাতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী রাজে বেশ কিছু নিয়ম বদলে দিয়েছিলেন। ৪০ বছরে প্রথমবার আরসিএ-তে নির্বাচন হয়। জিতে যায় ললিত। ২০০৫ সালে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট পদে জন্য ডালমিয়া-শরদ পাওয়ারের মধ্যে লড়াই চলে। পাওয়ারের পক্ষ নেন ললিত। তার ফল পেয়েছিলেন হাতেনাতে। সবচেয়ে কম বয়সে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্টের পদে বসেন।
‘বিলিয়ন ডলার বেবি’-র জন্ম
বছর দুয়েক মধ্যে আইসিসি ঠিক করল টি-২০ ফরম্যাটে বিশ্বকাপ খেলা হবে। প্রথম সংস্করণ জিতে ইতিহাস গড়ে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। ললিতের দীর্ঘদিনের ইচ্ছেটা ফের চাগাড় দিয়ে ওঠে। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ভিত্তিক টুর্নামেন্ট শুরুর এটাই যে মোক্ষম সময় তা বোঝানোর প্রয়োজন ছিল বোর্ডকে। ব্যবসা, রাজনীতি, ক্রীড়াজগত ও বিনোদন -সব ক্ষেত্রেই পরিচিতি তৈরি করেছিলেন। সেই কানেকশন কাজে লাগিয়ে ২০০৮ সালে জন্ম হয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়র লিগ বা আইপিএলের। বলিউড, ক্রিকেট এবং বিজনেস টাইকুনদের মিলিত সহযোগিতায় ললিত মোদির মস্তিষ্কপ্রসূত ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগের সূচনা।
আইপিএলের রাজার পতন
প্রথম সংস্করণ থেকেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছয় আইপিএল। ফুলে ফেঁপে ওঠেন ললিত মোদী। তবে বোর্ডের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে ধীরে ধীরে। ওঠে আর্থিক প্রতারণা এবং ম্যাচ গড়াপেটার মতো গুরুতর অভিযোগ। আইপিএলের নিলামে মোদি কমিশন খান বলে অভিযোগ ওঠে। শোনা যায়, সম্প্রচারকারী চ্যানেলের থেকে মিডিয়া রাইটস বিক্রির জন্য প্রচুর অর্থ নিয়েছিলেন। আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলকে বিভিন্ন বিষয়ে অন্ধকারে রাখার অভিযোগে ললিত মোদীকে সাসপেন্ড করে বিসিসিআই। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ। মোদির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। গ্রেফতারি এড়াতে রাতারাতি দেশ ছেড়ে লন্ডনে পালিয়ে যান ধুরন্ধর ব্যবসায়ী।
ইন্টারপোলের কাছে ললিতকে ভারতে ফেরানোর আর্জি জানায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। যদিও ২০১৭ সালে বিস্তর টালবাহানার পর সেই আর্জি খারিজ করে দেয় ইন্টারপোল। সেই থেকে বহাল তবিয়তে ললিত মোদী। ৫৮ বছর বয়সে প্রাক্তন বিশ্বসুন্দরীর সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর।