
একটা সময় যার কাছে নিজের ব্যাট কেনার টাকাটুকুও ছিল না, সেই মেয়েই আজ দেশের জার্সিতে বিশ্বমঞ্চে দাপিয়ে ক্রিকেট খেলছেন। বাংলার তথা দেশের হয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও ঝুলন গোস্বামীর পর বিশ্বকাপে খেলছেন রিচা ঘোষ (Richa Ghosh)। ২২ বছর বয়সী এই উইকেটকিপার ব্যাটারের পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে নিজেকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রিচা। কীভাবে সাফল্যের পথে হাঁটলেন রিচা, জেনে নিন বিস্তারিত।
রিচা ঘোষ এর জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে শিলিগুড়িতে। তাঁর বাবার নাম মানবেন্দ্র ঘোষ। মায়ের নাম স্বপ্না ঘোষ। রিচা শিলিগুড়ির মার্গারেট সিস্টার নিবেদিতা ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। মাত্র ৪ বছর বয়সে ব্যাট হাতে তুলে নিয়েছিলেন রিচা। শুরুতে তাঁর বাবাই ছিল ক্রিকেট খেলার অনুপ্ররণা। রিচার বাবার ক্লাব ক্রিকেটে খেলার এবং কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল। যে সময় মানবেন্দ্র ঘোষ ক্লাব ক্রিকেটে খেলতে যেতেন, রিচাও তাঁর সঙ্গে যেতেন। রিচার বাবা নিজেই মেয়ের ক্রিকেট খেলার দেখভাল করতেন, তাঁর প্র্যাকটিসেও নজর রাখতেন।
শুরুর দিনগুলোতে, শিলিগুড়িতে মেয়েদের ক্রিকেটের সুযোগ কম ছিল। যার ফলে প্রায়শই রিচাকে ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করতে হত। অবশ্য রিচার বাবা প্রথমে ভাবেননি মেয়ে ক্রিকেট খেলবে। শিলিগুড়িতে মেয়েদের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিও ছিল না। যার ফলে মানবেন্দ্র তাঁকে একটি টেবল টেনিস অ্যাকাডেমিতেও ভর্তি করান। অবশ্য তা আবার রিচার পছন্দ ছিল না। তাই বেশ কয়েকদিন টেবল টেনিস অ্যাকাডেমিতে যাওয়ার পর রিচা তাঁর বাবাকে জানিয়ে দেন যে, তিনি ক্রিকেট খেলতে চান। এরপর তাঁর বাবা ক্রিকেটের প্রতি রিচাকে উৎসাহিত করেন। মেয়েকে ব্যাট কিনে দেওয়ার জন্য টাকাও ধার করতে হয় রিচার বাবাকে।
এক সময় ক্লাব পর্যায়ে, বেশকিছু ছেলেরা তাঁর ক্রিকেট খেলার ধরন নিয়ে হাসাহাসিও করত। যা তাঁকে ক্রিকেটের প্রতি আরও দৃঢ় করেছিল। শুরুর দিকে রিচা ছিলেন অলরাউন্ডার। বোলিং, ব্যাটিং, উইকেটকিপিং— সব বিভাগেই দক্ষতা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি উইকেটকিপার-ব্যাটার হিসেবে ছাপ ফেলেছেন।
মেয়েদের ক্রিকেটে প্রাথমিক সময়ে স্বীকৃতি ও খেলার সুযোগ পাওয়াই কঠিন ছিল। বড় শহরের তুলনায় শিলিগুড়ির মতো জায়গায় প্রশিক্ষণ অর্থাৎ ট্রেনিংয়ের সুযোগ সীমিত ছিল। ক্লাব পর্যায়ে তাঁর খেলার কৌশল ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। পাশাপাশি মাঝে মাঝে রিচার খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়ার খরচ বহন করাও পরিবারের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে রিচা ক্রিকেটের পথে পাড়ি দিতে রিচা বরাবর নিজের পরিবারকে পাশে পেয়েছিলেন। শিলিগুড়িতে ক্রিকেট পরিকাঠামোর অভাব ছিল, তাই ক্রিকেটে উন্নতি করার জন্য শিলিগুড়ি ও কলকাতায় রিচাকে নিয়মিত যাতায়াত করতে হত।
২০১৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বাংলা অনূর্ধ্ব-১৯ (U-19) দলে সুযোগ পান। সেখানে নজর কাড়ার পরপরই অল্প সময়ের মধ্যে রাজ্য দলে জায়গা করে নেন। বাংলার মেয়ের প্রতিভা ও সম্ভবনার কথা মাথায় রেখে ২০২০ সালে আইসিসি মেয়েদের টি-২০ বিশ্বকাপের ভারতীয় স্কোয়াডেও রাখা হয় রিচাকে। এরপর সে বছরই ত্রিদেশীয় সিরিজের স্কোয়াডেও সুযোগ পান তিনি। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ত্রিদেশীয় সিরিজে টি-২০ অভিষেক হয় রিচার। এরপর ২০২১ সালের মে মাসে প্রথম বার বোর্ডের কেন্দ্রীয় বার্ষিক চুক্তির আওতায় আসেন রিচা। এরপর ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওডিআইতে ডেবিউ হয় রিচার। ভারতের হয়ে টেস্ট টিমে তাঁর ডেবিউ হয় ২০২৩ সালের ২১ ডিসেম্বর।
দেশের মাটিতে চলতি আইসিসি মহিলা ওডিআই বিশ্বকাপে অ্যাকশনে দেখা যাচ্ছে রিচাকে। দেশের উইকেটকিপার-ব্যাটার রিচা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৯৪ রানের ইনিংস উপহার দিয়েছেন। ৮ নম্বরে নামা কোনও ব্যাটারের করা সর্বাধিক রান এটাই।
উল্লেখ্য, WPL (Women’s Premier League)–এ Royal Challengers Bengaluru দল তাঁকে ২০২৩ সালে নিয়েছিল। তিনি পেয়েছিলেন ১.৯০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে RCB–র হয়ে WPL–এ ভাল পারফরম্যান্স তুলে ধরেছিলেন রিচা। দলের তৃতীয় সর্বাধিক রান সংগ্রহকারী ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগের পাশাপাশি মেয়েদের বিগ ব্যাশ লিগ ও উইমেন্স হান্ড্রেডে খেলেছেন রিচা।
দেশের জার্সিতে রিচা ৬৭টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে। তাতে করেছেন ১০৬৭ রান। সর্বাধিক ৬৪*। এ ছাড়া ৪৭টি আন্তর্জাতিক ওডিআই ম্যাচ খেলেছেন রিচা। তাতে করেছেন ১০৭৩ রান। সর্বাধিক ৯৬। এ ছাড়া ভারতের হয়ে টেস্টে ২টি ম্যাচ খেলেছেন রিচা। সেখানে প্রাপ্তি ১৫১ রান। সর্বাধিক ৮৬। ধৈর্য, অধ্যবসায় ও কঠোর মনোভাব অটুট রেখে আজ রিচা ঘোষ ভারতের নারী ক্রিকেটে উজ্জ্বল নাম।