Kolkata Derby Retro Story: ‘বড় ম্যাচ জিতে হীরের আংটি পেয়েছিলাম’, ডার্বির অজানা গল্প শোনালেন গৌতম সরকার

তিন বছর পর আবার ডার্বি (Derby) ফিরছে কলকাতায়। সেই চিরকালীন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বির নানা গল্প নিয়েই টিভি নাইন বাংলার এই ধারাবাহিক--- ডার্বির হারিয়ে যাওয়া গল্প। আজ অতীতে ফিরলেন গৌতম সরকার (Gautam Sarkar)।

Kolkata Derby Retro Story: 'বড় ম্যাচ জিতে হীরের আংটি পেয়েছিলাম', ডার্বির অজানা গল্প শোনালেন গৌতম সরকার
'বড় ম্যাচ জিতে হীরের আংটি পেয়েছিলাম', ডার্বির অজানা গল্প শোনালেন গৌতম সরকার
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Aug 15, 2022 | 3:46 PM

ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস সেই কবে থেকে ময়দানের জার্সি পরে বসে রয়েছে! নতুন শতাব্দীতে পা দিয়েও ময়দান ঘিরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে রয়েছে ইতিহাস। কত গল্প উপহার দিয়েছে এই ময়দান। আরও ভালো করে বলতে গেলে, কলকাতা (Kolkata Football) ডার্বি ঘিরে কত উত্তেজনা, কত উত্তাপ। তিন বছর পর আবার ডার্বি (Derby) ফিরছে কলকাতায়। সেই চিরকালীন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বির নানা গল্প নিয়েই টিভি নাইন বাংলার এই ধারাবাহিক— ডার্বির হারিয়ে যাওয়া গল্প। আজ প্রথম কিস্তি। বাঙালির বড় ম্যাচের অজানা গল্প শোনালেন ময়দানের ‘বেকেনবাওয়ার’ গৌতম সরকার (Gautam Sarkar)।

ডার্বি নয়, বড় ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ এখনকার ছেলেপিলেদের কাছে ডার্বি হলেও আমাদের কাছে ছিল বড় ম্যাচ। এখন তো আবার বিদেশিদের দখলেই চলে গিয়েছে বড় ম্যাচ। আমাদের সময় ছিল বাঙালির বড় ম্যাচ। ভিন রাজ্যের ফুটবলাররা খেলতে এলেও, বড় ম্যাচে দাপট ছিল বাঙালিদেরই। হাবিব (বড়েমিয়াঁ), শ্যাম, সুরো (সুরজিৎ), সমরেশ (পিন্টু), সুভাষ (ভোম্বল), সুব্রত (বাবলু), প্রশান্ত আরও কত কত নাম উঠে আসত। আমরা সবাই এই বড় ম্যাচের অপেক্ষায় থাকতাম। বলা হত, পাড়ার টুর্নামেন্টেও যদি ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের জার্সি পরে কোনও দুটো টিম মুখোমুখি নামে, তা হলেও তীব্র উত্তেজনা থাকবে। লিগ, শিল্ড, ডুরান্ড— যে কোনও টুর্নামেন্টেই বড় ম্যাচের গুরুত্ব ছিল আলাদা। সমর্থকরা ওই ম্যাচের দিকেই তাকিয়ে থাকত। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের দিন ঘোষণার পনেরো দিন আগে থেকেই সমর্থকরা ভিড় জমাতে শুরু করত তাঁবুতে। আমরাও উত্তাপ টের পেতাম। এখন তো যুবভারতীতে বড় ম্যাচ হয়। আমাদের সময় বেশির ভাগ বড় ম্যাচই হত ঘেরা মাঠে। ইস্টবেঙ্গল কিংবা মোহনবাগান মাঠ, নয়তো ইডেন গার্ডেন্সে। ঘেরা মাঠে কিন্তু সমর্থকরা ফুটবলারদের অনেক কাছে থাকে। ফলে চাপটা বেশি টের পেতাম আমরা।

১৯৭২ থেকে ১৯৮৪। ১২ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারে প্রচুর বড় ম্যাচ খেলেছি। এই সব বড় ম্যাচের সুবাদেই নাম, যশ হয়েছে। আমাকে ‘ভারতের বেকেনবাওয়ার’ বলে সবাই। আমি গৌতম সরকার হিসেবেই ফুটবল কেরিয়ার শুরু করেছিলাম। অন্যান্য ম্যাচে ভালো খেললেও, বড় ম্যাচের সাফল্য আমাকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল। কলকাতা লিগ, আইএফএ শিল্ডের পাশাপাশি ডুরান্ডের বড় ম্যাচের অনেক ভালো স্মৃতিও রয়েছে। যা আজীবন মণিকোঠায় থেকে যাবে।

প্রথম বড় ম্যাচ খেলি ১৯৭২ সালে। তখন আমি ইস্টবেঙ্গলে। লিগের ম্যাচ। প্রথম বার বড় ম্যাচে খেলব। একটু নার্ভাস ছিলাম। তবে মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত টেনশনে ঘুমোতে পারিনি। মাঠে নামার আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। জীবনের যে কোনও বড় মঞ্চে নামার আগে মায়ের মুখ দেখতাম। মা-ই ছিল আমার প্রেরণা। অনেক কঠিন যুদ্ধও অনায়াসে জিতে যেতাম। ওই দিনও তাই ই হয়েছিল। প্রথম বড় ম্যাচ জিতেছিলাম আমরা।

তখন ৪-২-৪ ফর্মেশনে খেলা হত। ইস্টবেঙ্গলে সই করার পর আমাকে কিছুতেই বসাতে পারছিলেন না প্রদীপদা। দলের অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছি। ও দিকে পিন্টু (সমরেশ চৌধুরী) আর মোহনও ভালো খেলছে। ওদেরও প্রদীপদা বসাতে পারছেন না। ওই প্রথম ৪-২-৪ ছক ভেঙে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলালেন প্রদীপদা। ওটা ক্লিক করে গেল। ভারতীয় ফুটবল ওই প্রথম বার ৪-৩-৩ ফর্মেশন কার্যকরী ফুটবল খেলা দেখল। আমি, পিন্টু আর মোহনের খেলা দর্শকদের মন জয় করে নিল। প্রথম বড় ম্যাচেও জিতলাম। হাবিবের গোলে মোহনবাগানকে ১-০ হারিয়েছিলাম।

আমার জীবনে যা সাফল্য এসেছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব প্রদীপদার। অনেকের কোচিংয়েই খেলেছি। কাউকে খাটো করছি না, কিন্তু প্রদীপদার কোচিংয়ে জাদু ছিল। কাকে দিয়ে কোন কাজটা করানো যায়, ভালো বুঝতেন। এই প্রসঙ্গে ১৯৭৮ সালের বড় ম্যাচের কথা বলতে হবে। শরীর খারাপের জন্য লিগে ৪-৫টা ম্যাচ খেলতে পারিনি। প্র্যাক্টিসে অবশ্য রোজ যেতাম। কিন্তু প্রদীপদা মাঠে নামাতেন না। মান্নাদাও তখন প্রদীপদাকে বলতেন আমাকে মাঠে নামানোর জন্য। প্রদীপদা চুপ করে থাকতেন। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তবে আমিও মনে মনে জেদ চেপে রেখেছিলাম। মাঠে নামলেই নিজেকে প্রমাণ করে ছাড়ব। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে আমাকে মাঠে নামালেন প্রদীপদা। সুরজিৎ তখন ইস্টবেঙ্গলে। একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে বল পেয়ে গিয়েছে। সামনে শুধু শিবাজী। শট মারলেই গোল। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরাও চিৎকারের জন্য তৈরি। ঠিক ওই সময় একটা ট্যাকেলে সুরজিতের পা থেক থেকে বলটা কেড়ে নিই। আমরা কাউন্টার অ্যাটাকে খেলেছিলাম। ম্যাচটা ১-০ জিতে ফিরেছিলাম। ম্যাচের পর জানতে পারি, প্রদীপদা আমাকে নামানোর জন্য তৈরিই ছিলেন। সবাইকে বলেও রেখেছিলেন। শুধু আমিই জানতাম না। উনি জানতেন, কী ভাবে কাকে দিয়ে আসল কাজটা করাতে হয়।

‘৭৫-র বড় ম্যাচের কথা তো সবাই বলে। তবে আমার জীবনের সেরা ১৯৭৯ সালের বড় ম্যাচ। তখন আমি মোহনবাগানে। আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে ১-০ হারিয়েছিলাম। আমার গোলেই জিতেছিল দল। শ্যাম, মানস, বিদেশরা ওই দিন অনেক চেষ্টা করেও গোল পায়নি। শেষ পর্যন্ত আমি গোল করি। মোহনবাগান মাঠে খেলাটা হয়েছিল। সমর্থকদের মাথায় চেপে মাঠ ছেড়েছিলাম।

অনেকের কাছে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের প্রশংসা পেয়েছি। বড় ম্যাচ তো অনেককেই নায়ক বানিয়ে দেয়। ভালো খেললে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। আমার ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছিল। অনেক উপহার পেয়েছি। সে সব সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে। ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় তৎকালীন ফুটবল সচিব অজয় শ্রীমানি আমাকে হীরের আংটি দিয়েছিলেন। আর একটা ঘটনাও মনে রাখার মতো। তখন আমি মোহনবাগানে। সবে আমার বিয়ে হয়েছে। খেলা থাকায় কোথাও ঘুরতে যেতে পারছি না। বড় ম্যাচ জেতার পর মোহনবাগানের তিওয়ারিদা আমার হাতে শিলংয়ের টিকিট ধরিয়ে দিলেন। এ সব ঘটনা কখনও ভোলার নয়।

(কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেওয়া সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)