Morocco vs Spain: মরক্কোর কোনও এক কাঁটাতারে লটকে স্পেনের তিকিতাকা!

FIFA World Cup : ইবন বতুতার দেশ মরক্কোয় প্রথম বসতি গড়েছিল রোমানরা। অষ্টম শতকে মুসলিমদের আইবেরিয়ান উপদ্বীপ জয়ের 'লঞ্চপ্যাড' ছিল মরক্কো। সেখানে পরে একে একে আসে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ও ফরাসিরা। ইতিহাস সে সব মনে রেখেছে। যেমন মনে রাখবে, মরক্কানদের স্পেনবধের কাহিনিও। মাঠের এই গল্পের খোরাক যুগিয়েছে বিবর্ণ ইতিহাসই। জানেন কী সে সব?

Morocco vs Spain: মরক্কোর কোনও এক কাঁটাতারে লটকে স্পেনের তিকিতাকা!
Image Credit source: GOOGLE
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 07, 2022 | 7:25 PM

নীলাঞ্জন বসু

কাঁটাতারের বেড়ায় চড়ে রক্তাক্ত কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি তরুণ-কিশোরের দল। কেউ কেউ প্রাণপণে ঝাঁকিয়ে চলেছেন অস্থায়ী ‘দেওয়াল’। এক পাড়ে তৎপর মরোক্কান পুলিশ-সেনা, অন্য পাড়ে স্প্যানিশ বর্ডার গার্ড। কখনও হিসহিসিয়ে ছুটছে বুলেট, কখনও ব্যাটন আছড়ে পড়ছে হাড়হাভাতে শরীরে। তবু ইউরোপ পাড়ির স্বপ্নে বাঁধ দেবে কে!

শুধু মরক্কানরা নেই দলে। আছেন তিউনিশায়ান, সেনেগালিজ, নাইজিরিয়ান, লিবিয়ান, সিরিয়ান…। কারও দেশ বিধ্বস্ত যুদ্ধ-বোমায়, কারও কাজ নেই কোনও, নেই দু-বেলা খাবারের ঠিক-ঠিকানা। সে কারণেই ইউরোপের প্রবেশদ্বারে গণ-উল্লম্ফন। নাছোড় জনতার ভালো থাকার, সুস্থ ভাবে বাঁচার এক অঘোষিত সংগ্রাম। এমন দৃশ্যে ড্রপসিন নেই।

কাতার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় স্পেন বনাম মরক্কোর লড়াই সবুজ ঘাসের ঘেরাটোপে আটকে ছিল না। ড্রিবল, ডিফেন্স, স্কোয়্যার পাস, বানানা কিক, টাইব্রেকার সেভের ফুলকি এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম পেরিয়ে উড়ে এসে পড়েছে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক ইতিহাস বুকে নিয়ে চলা আম মরোক্কানদের জীবনের নাটমঞ্চেও। ইউরোপ ও আরব দুনিয়া– যুদ্ধ-সন্ধি, প্রেম-প্রীতি-ঘৃণার আখ্যানে মাত্রা জুড়েছে ফুটবলের রঙ।

সেউতা ও মেলিয়া– উত্তর আফ্রিকার দুই স্প্যানিশ এনক্লেভ। আমাদের ভাষায় ছিটমহল। কাঁটাতার টপকে চাপাপড়া জীবন থেকে মুক্তির যে মরিয়া চেষ্টা, তারই সাক্ষী জিব্রাল্টার প্রণালী ও ভূমধ্যসাগর পাড়ের দুই এলাকা। খাস আফ্রিকায় সেউতা ও মেলিয়ায় স্পেনের ঔপনিবেশিক দখলদারি আজও জারি। তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, স্পেন সরকার, মরক্কোর সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের হাতধরাধরি, দরকষাকষি, নরমে-গরমে সাম্প্রতিক অতীত জটিল-কুটিল। ইউরোপে ঢুকতে জীবনপণ করা কালো মানুষদের তাই বেদম ঠ্যাঙায় মরোক্কোর পুলিশ ও সেনা। স্পেনের অতি-দক্ষিণপন্থীরা আরব-আফ্রিকান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে রুটিন করে তোপ দাগলেও বিনিয়োগের কুমিরছানা দেখিয়ে মরক্কোর শাসকদের বাগে আনতে মাঠে নেমে পড়েন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কর্তাব্যক্তিরা। মরক্কোকে সমস্যায় ফেলতে সুযোগ বুঝে পশ্চিম সাহারার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় মদত দেয় মাদ্রিদ। ভূমধ্যসাগরে ঢেউ ওঠে, আবার ভাঙে।

মেলিয়া ও মরক্কোর মধ্যে কাঁটাতার রয়েছে প্রায় ১২ কিলোমিটারের। আর ৮ কিলোমিটার সেউতায়। দু-পাড়ে আইনি-বেআইনি পণ্য লেনদেন কখনও বন্ধ, কখনও খোলা। ‘বর্ডার স্টোরিজ’-এর তথ্যচিত্রে দেখা মেলে সীমান্তবর্তী এই দুই এলাকায় আশা-হতাশার জোয়ার-ভাটায় ভাসছেন মরক্কোর সব বয়সি মানুষ। কেউ কেউ হয়তো ঢুকে পড়তে পেরেছেন স্পেনের এলাকায়, সমুদ্র সাঁতরে বা গাড়িতে লুকিয়ে। কিন্তু কাগজপত্র নেই। গাড়ি ধুয়েমুছে বা মামুলি পণ্য ফেরি করেই তাঁদের দিন গুজরান। কেউ কেউ অপেক্ষা করে রয়েছেন মরক্কোর জঙ্গলে। প্রাণ যায় যাক, যদি সুযোগ মেলে!

ইবন বতুতার দেশ মরক্কোয় প্রথম বসতি গড়েছিল রোমানরা। অষ্টম শতকে মুসলিমদের আইবেরিয়ান উপদ্বীপ জয়ের ‘লঞ্চপ্যাড’ ছিল মরক্কো। সেখানে পরে একে একে আসে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ও ফরাসিরা। স্প্যানিশ ও ফরাসিরা দেশটিকে দু-ভাগে ভাগ করে শাসন ক্ষমতা বজায় রেখেছিল বিংশ শতাব্দীতেও। পঞ্চদশ শতাব্দীতেই মেলিয়ার দখল নেয় স্পেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে সেউতার। পঞ্চদশ ও ষোড়োশ শতাব্দীতে যখন ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশের ঠিকানা খুঁজে দিচ্ছেন, তখনই আইবেরিয়ান উপদ্বীপ মানে স্পেন ও পর্তুগাল থেকে মুসিলমদের উৎখাত শুরু। সেউতা ও মেলিয়ায় ‘রেকোনকিস্তা’ বা পুনর্দখল শুরু করে স্প্যানিশরা। ১৯৫৬ সালে মরক্কো স্বাধীনতা পেলেও সেউতা, মেলিয়া-সহ আরও কয়েকটি ছোট ছোট এলাকা এখনও দখলে রেখে দিয়েছে স্পেন। পশ্চিম তথা খ্রিস্টান বিশ্বের হাতে আরব-মুসলিমদের অবমাননার ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়েছে গিয়েছে সেউতা ও মেলিয়া। এক সময় সাবেক পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানি আলাদা করে রাখা বার্লিন ওয়াল নিয়ে আবেগের বন্যা বইলেও মরক্কোর দিকে তথাকথিত উন্নত বিশ্ব তেমন নজর দেয়নি কোনও দিন। স্পেনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে, আফ্রিকার মাটিতে রাবাতের (মরক্কোর রাজধানী) দাবি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বার বার দেওয়া হয়েছে উড়িয়ে। ‘দেওয়াল’ ভাঙার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও। বর্তমানে সেউতা-মেলিয়া নিয়ে কোনও আলোচনাতেই নারাজ মাদ্রিদ। পাঁচশো বছরের বেশি সময় ধরে এলাকা দুটি তাদের তাঁবে রয়েছে, এই যু্ক্তিই ঢাল স্প্যানিশদের।

শাসকের যুক্তি, কৌশলে নাশকতা চালায় গণ-প্রতিরোধের বিস্ফোরণ। তার ছটা পড়ে ফুটবল মাঠে। সেই দেওয়াল, সেই কাঁটাতার! তবে এবার বিদ্ধ স্প্যানিশ কোনকিস্তাদোররা (বিজয়ী)। কোনও এক কাঁটাতারেই তো কেঁদে মরেছে তিকিতাকার শিল্প। বোনো, হাকিমি, সাইস…। মুখগুলো বদলে যায়। সেউতা, মেলিয়াতেও হয়তো এখন যন্ত্রণার বদলে শুধুই খুশির রঙ। কোথায় যেন শোনা যায় পিঙ্ক ফ্লয়েডের কলি– ‘অল ইন অল, ইউ আর জাস্ট অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল’।