মাথায় হাত চাষির, কেন ‘বর্ষাল্পতা’য় বিবর্ণ গাঙ্গেয় বাংলা?
মরসুমের গোড়াতেই মৌসম ভবন বলে দিয়েছিল, দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টি হবে। কিন্তু ঘাটতির ফাঁড়া দক্ষিণবঙ্গের কপালে। জুন-জুলাই নিয়েও আলাদা করে আশঙ্কার বাণী শুনিয়েছিলেন আবহবিদরা। অক্ষরে অক্ষরে মিলেছে সেই পূর্বাভাস। এ বার অগস্ট নিয়েও ঘাটতি-বর্ষার বার্তা দক্ষিণবঙ্গে।
কমলেশ চৌধুরী
এ যেন প্রকৃতির একুশে আইন! ২০২১-এ বারবার বৃষ্টির ঝাপ্টায় তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার মানুষজন। জুনেই ৩৯৮.৫ মিলিমিটার বৃষ্টির সাক্ষী হয়েছিল আলিপুর। বাইশে বরাদ্দ কম। একটু-আধটু কম নয়। পয়লা জুন থেকে ৫ অগস্ট আলিপুরে কতটুকু বৃষ্টি হয়েছে জানেন? মাত্র ৩৯৬ মিলিমিটার। গত বছর ৩০ দিনে যা বৃষ্টি হয়েছিল, এ বার ৬৬ দিনে বৃষ্টি হয়েছে তার চেয়েও কম।
বৃষ্টি কম হওয়ায় অবশ্য কলকাতার আখেরে লাভই। জল-যন্ত্রণা সইতে হচ্ছে না। ফি বছরের মতো জলে ডোবা বেহালার ছবি এ বার এখনও দেখতে হয়নি। কলকাতাবাসীর কষ্ট বলতে ভ্যাপসা গরমে প্রতিদিন নাজেহাল হওয়া। বাতাসে জলীয় বাষ্প প্রচুর। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায়, অতিরিক্ত আর্দ্রতাই চূড়ান্ত অস্বস্তির কারণ। তবে আসল সমস্যা গ্রামে। আসল সমস্যা চাষির।
বর্ষার এই সময়টায় চাষির ব্যস্ততার শেষ থাকে না। পাট পচানোর সময়। বীজতলা থেকে আমন ধানের চারাগাছ তুলে জমিতে রোপণ করার সময়। পাট পচাতে যত দেরি হবে, তন্তুর মান তত খারাপ হবে। বাজারে দাম পাবেন না চাষি। আবার আমন ধান রোপণে যত দেরি হবে, তত চিন্তার ভাঁজ কপালে রেখে দিন গুনতে হবে চাষিকে। অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় প্রবণ মাস। থেকে যাবে পাকা ধানে মই পড়ার আশঙ্কা। পাট হোক ধান, দুই ফসলের জন্য়ই প্রচুর জল দরকার। পাটে চাষের পর, ধানে চাষের শুরু থেকেই। অথচ, সেই জলটাই নেই। ‘বর্ষাল্পতা’য় ভুগছে গোটা গাঙ্গেয় বাংলা। উত্তরবঙ্গের মালদহ, দুই দিনাজপুরও। শুধু ঘাটতির ঘনঘটা।
ঠিক কতটা ‘বর্ষাল্পতা’য় ভুগছে দক্ষিণবঙ্গ?
আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যানে নজর রাখা যাক। জুনে ঘাটতি ছিল ৪৮%, জুলাইয়ে ঘাটতি ৪৬%। জুন-জুলাই মিলিয়ে ঘাটতি ৪৭%। ৫ অগস্ট পর্যন্ত ঘাটতি দাঁড়িয়ে ৪৬ শতাংশে। অর্থাত্, প্রায় অর্ধেক বৃষ্টিই হয়নি। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি মুর্শিদাবাদে, ৬৩%। শস্যগোলা বর্ধমানে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪% কম বৃষ্টি হয়েছে। হুগলিতে ঘাটতি ৪০%। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূমে এমনিতেই জলের অভাব। এ বছরের যা ঘাটতি, তাতে এই জেলাগুলিতে ধানের উত্পাদন যে কম হবে, সে কথা এখনই হলফ করে বলে দেওয়া যায়। দার্জিলিং, কালিম্পং, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারে বারবার ঝেঁপে বৃষ্টি নামলেও, বাকি উত্তরবঙ্গে পরিস্থিতি দক্ষিণের মতোই শোচনীয়। ৪৭% ঘাটতি মালদহে।
এমন শোচনীয় দশা হল কেন?
গত বছর কিছু দিন যেতে না যেতেই একটি করে নিম্নচাপ হাজির হচ্ছিল। আর ভেসে যাচ্ছিল বাংলা। এ বার সেই নিম্নচাপেরই দেখা নেই। দেখা নেই বললে অবশ্য ভুল বলা হবে। নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু ওড়িশা-ঘেঁষে, আরও স্পষ্ট করে বললে ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে। সেই নিম্নচাপ ওড়িশা হয়ে মধ্য ভারত, এমনকী গুজরাতে পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টি দিয়েছে, কিন্তু বাংলার ঝুলি ভরেনি। মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘বর্ষায় উত্তর বঙ্গোপসাগর থেকে দক্ষিণবঙ্গ হয়ে রাজস্থানের গঙ্গানগর পর্যন্ত মৌসুমি অক্ষরেখা বিস্তৃত থাকে। এটাই স্বাভাবিক অবস্থান বলে ধরা হয়। কিন্তু এ বার জুনে মৌসুমি অক্ষরেখা ছিল উত্তরে। ফলে উত্তরবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারতে ঢেলে বৃষ্টি হয়েছে। জুলাইয়ে সব নিম্নচাপ যেহেতু ওড়িশা-ঘেঁষে সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু অক্ষরেখাও ছিল দক্ষিণে, ওড়িশার দিকে। ফলে দক্ষিণবঙ্গে কখনওই ভারী বা অতিভারী বৃষ্টি হয়নি।’’
অথচ দেশের অন্য রাজ্যের ছবি দেখুন। প্রবল বৃষ্টিতে বন্যার মুখে পড়েছে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, তেলঙ্গানা। মরুরাজ্য রাজস্থানেও অতিবৃষ্টি। পশ্চিম রাজস্থানে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭৪% বেশি বৃষ্টি হয়েছে, পূর্ব রাজস্থানে ২৫% উদ্বৃত্ত বৃষ্টি। গত ক’দিন ধরে ভাসছে কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক। ফুঁসছে কাবেরীর মতো একাধিক দক্ষিণী নদী। দেশে সার্বিক ভাবে ৬% বেশি বৃষ্টি হয়েছে। যত ঘাটতি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে। নিম্নচাপ পা রাখেনি। তাই এই দুর্দশা।
অবশ্য এই দুর্দশা হঠাত্ করে হয়নি। মরসুমের গোড়াতেই মৌসম ভবন বলে দিয়েছিল, দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টি হবে। কিন্তু ঘাটতির ফাঁড়া দক্ষিণবঙ্গের কপালে। জুন-জুলাই নিয়েও আলাদা করে আশঙ্কার বাণী শুনিয়েছিলেন আবহবিদরা। অক্ষরে অক্ষরে মিলেছে সেই পূর্বাভাস। এ বার অগস্ট নিয়েও ঘাটতি-বর্ষার বার্তা দক্ষিণবঙ্গে।
দুর্দশা কি কাটবে না?
তাকিয়ে থাকতে হবে নিম্নচাপের দিকেই। আবহবিদরা জানাচ্ছেন, ৭ অগস্ট নতুন নিম্নচাপের জন্ম হতে পারে বঙ্গোপসাগরে। বাংলার মন্দ কপাল, এ বারও নিম্নচাপের সম্ভাবনা সেই ওড়িশা-অন্ধ্র উপকূলে। ওড়িশা, তার পর ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ, মধ্যপ্রদেশ, এমনকী গুজরাতেও ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছে মৌসম ভবন। বাংলার বরাদ্দ কী হবে? আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস, ৮ তারিখের পর বৃষ্টি বাড়তে পারে উপকূলীয় জেলায়। ১০ তারিখ কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের ৮ জেলায় ভারী বৃষ্টি হতে পারে। যদিও জেলায় জেলায়, মাঠে মাঠে আমন ধানের গোড়ায় জল দাঁড়িয়ে যাবে, এমন বৃষ্টির আশা কিছুতেই করা যাচ্ছে না।
অথচ, গত মরসুমে অতিবৃষ্টির ঠেলায় বারবার ধানচাষে ক্ষতি হয়েছে। দু’বার করে বীজতলা বসাতে হয়েছিল বহু চাষিকে। নভেম্বরে তো বটেই, ডিসেম্বরেও ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে বৃষ্টির জলে ধুয়েছে পাকা ধান। তার প্রভাব অনেক দিন ধরেই টের পাচ্ছেন আমজনতা। প্রতি কেজিতে অন্তত দশ টাকা বেড়েছে চালের দাম। সেই যে বেড়েছে, আর কমেনি। পেট্রোল-ডিজেলের দাম, গ্যাসের দাম– সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি তো আছেই। অনাবৃষ্টির কোপ চলতে থাকলে কোথায় পৌঁছবে চালের দাম? বেয়াড়া প্রকৃতির একুশে আইন! শুরুতে ভুলে বলেছিলাম কি?