Typhoon Noru: ৫,০০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পুজোর বাংলাকে তাক বর্ষাসুরের?
Weather Update: ঘূর্ণাবর্তের প্রভাব পড়বে—ধরে নিয়েই সপ্তমী থেকে দক্ষিণবঙ্গে, নবমী থেকে উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে হাওয়া-অফিস।
কমলেশ চৌধুরী
পুরাণ মতে, মর্ত্য থেকে স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছিলেন মহিষাসুর। সে পথ কতটা, কেউ মাপেনি। এ বার মহিষাসুরমর্দিনীর পুজোয় যে অসুরের আনাগোনা নিয়ে উদ্বেগে বাংলা, সে কতটা পথ পেরিয়ে আসছে, জানেন কি? ঠিকই ধরেছেন, প্রশ্নটা বর্ষাসুরকে নিয়েই। যার আগমন ঘিরে পুজোর বাংলায় বৃষ্টির জোর আশঙ্কা। পথ নেহাত কম নয়—অন্তত পাঁচ হাজার কিলোমিটার।
অবাক হচ্ছেন? ৫ হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পুজো মাটি করতে আসছে বর্ষাসুর? একটু খোলসা করেই বলা যাক।
‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’, ‘কালিকা পুরাণ’ ঘাঁটলে মহিষাসুরের জন্মবৃত্তান্ত পাওয়া যায়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যে অসুরের উদয় হবে, তার জন্মকাহিনি জানতে নজর রাখতে হয়েছিল ফিলিপাইন অ্যাটমস্ফেরিক জিওফিজিক্যাল অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সার্ভিসেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর নথিতে।
কেন ফিলিপিন্স?
কারণ, যে অসুরের কথা বলা হচ্ছে, তার জন্ম ফিলিপিন্স সাগরে। ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ থেকে অন্তত ১,৬০০ কিলোমিটার দূরে। এই পথেই শক্তি বাড়াতে-বাড়াতে সুপার টাইফুনে পরিণত হয়েছিল ‘নোরু’। সেই শক্তিতেই, মানে ঘণ্টায় ২৫৫ কিলোমিটার বেগে ঝড় তুলে আছড়ে পড়ে ফিলিপিন্সের স্থলভাগে। তার পর দক্ষিণ চিন সাগর হয়ে এ বার গন্তব্য ভিয়েতনাম উপকূল। তবে ফিলিপিন্স পেরোলেই যেমন সাগর ছিল, ভিয়েতনাম পেরোলেই তা নয়। দীর্ঘ স্থলভাগের ঘেরাটোপ। মানে পর পর দেশ। লাওস, থাইল্যান্ড, মায়ানমার। ফলে টাইফুন ক্রমে শক্তি হারাবে। কিন্তু মায়ানমার পেরোলেই আবার জলভাগ অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর। ফলে জলীয় বাষ্পের জ্বালানি পেয়ে ফের চেগে ওঠার সুযোগ পাবে টাইফুনের অবশিষ্টাংশ।
একেবারে শুরুতে ঘূর্ণাবর্ত। যে পূর্বাভাস ২৬ সেপ্টেম্বর, সোমবার, মহালয়ার পরের দিনই দিয়েছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “১ অক্টোবর অর্থাৎ ষষ্ঠীতে পূর্ব-মধ্য ও লাগোয়া উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হতে পারে।” এই জায়গাটা আসলে মায়ানমার উপকূলের কাছেই। এরপর সেই ঘূর্ণাবর্ত যদি বাংলা বা ওড়িশা উপকূলের কাছে পৌঁছয়, তাহলে গোটা পথের দূরত্বটা দাঁড়াবে পাক্কা পাঁচ হাজার কিলোমিটারে। সেই আশঙ্কা যে একেবারে নেই, তা নয়। ঘূর্ণাবর্তের প্রভাব পড়বে—ধরে নিয়েই সপ্তমী থেকে দক্ষিণবঙ্গে, নবমী থেকে উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে হাওয়া-অফিস।
যত উৎপাত কি উৎসবেই?
এ বছর বর্ষার গোড়া থেকেই ভুগিয়েছে বৃষ্টি। গতবারের মতো অতিবর্ষণ নয়, বলা ভাল অনাবৃষ্টি। জুন, জুলাই মাসে ঘাটতি এমন জায়গায় পৌঁছয়, বিপুল ক্ষতি পাট আর ধানচাষে। অগস্টের বৃষ্টিতে মাটি কিছুটা ভিজলেও, ঘাটতি মোছেনি। সোমবার পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে ঘাটতি ২৫%। অর্থাৎ চার ভাগের একভাগ বৃষ্টিই হয়নি। সেই ঘাটতি কি সুদে-আসলে পূরণ করবে বর্ষা?
আমজনতা আশঙ্কায়। তবে আবহবিদরা বলছেন, জুলাই-অগস্টের মতো না হলেও, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বৃষ্টি নেহাত কম হয় না। ফলে পুজোয় বৃষ্টি হলে সেটাকে কিছুতেই অস্বাভাবিক বলে দেগে দেওয়া যাবে না। আবহাওয়া দফতর বলছে: স্বাভাবিক বর্ষণ হলেই সেপ্টেম্বরে ৩১৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা কলকাতায়। মাস হিসেবে তৃতীয় সর্বোচ্চ, পরিমাণে জুনের চেয়েও বেশি। ১৯৭৮ সালে বাংলা যে বন্যার মুখোমুখি হয়েছিল, তা তো সেপ্টেম্বরের অতিবর্ষণেই। দৈনিক বৃষ্টির অঙ্কে কলকাতায় রেকর্ড ওই বছরই। ২৮ সেপ্টেম্বর আলিপুরে একদিনেই ঝরেছিল ৩৬৯.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি। কাছাকাছি না পৌঁছলেও, পাল্লা দিয়েছিল ২০২১ মানে—গত বছরের বর্ষাও। গোটা মাসে কলকাতায় ৬১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি, শুধু ২০ সেপ্টেম্বরই ঝরেছিল ১৪২ মিলিমিটার। তারপর অক্টোবরে নিম্নচাপের কুনজরে পড়ে যায় পুজো। উৎসব মাটি হয়নি ঠিকই, তবে অষ্টমী-রাত থেকে বারবার বিঘ্ন ঘটায় বৃষ্টি।
বঙ্গীয় ক্যালেন্ডারে অক্টোবর শরৎ-হেমন্তের মিশেল হলেও, বৃষ্টির আনাগোনা নেহাত কম নয়। অক্টোবরে কলকাতার ঝুলিতে বরাদ্দ ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি—অর্থাৎ অন্তত ৭টি ‘রেইনি ডে’। এর অন্যতম কারণ, অক্টোবরের একটা বড় সময় জুড়ে বর্ষা থাকে রাজ্যে। ১২ অক্টোবর লেগে যায় কলকাতা থেকে বিদায় নিতেই। কোনও-কোনও বছর দেরি হয় অনেক বেশি। যেমন, ২০২০ সালে কলকাতা থেকে মৌসুমি বাতাস বিদায় নিয়েছিল ২৮ অক্টোবর।
অবশ্য বর্ষা বিদায় নিলেই যে বৃষ্টির হাত থেকে মুক্তি, তা নয় একেবারেই। বর্ষা যেতে না-যেতেই শুরু হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় মরসুম। ২০১৩ সালে ওড়িশার গোপালপুরে আছড়ে-পড়া ঘূর্ণিঝড় ‘পিলিন’-এর জন্য নবমী-দশমীতে ভেসেছিল বাংলা। পুজোর পর ডিভিসির ছাড়া জলে বন্যার মুখেও পড়তে হয় হাওড়া, হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকাকে। যদিও এ বার অক্টোবরের শুরুতে পিলিনের কোনও উত্তরাধিকারীর আগমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ ‘নোরু’ থেকে ‘সিতরাং’ জন্মাবে, সেই আশঙ্কা প্রায় নেই। পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি, “নোরু-র অবশিষ্টাংশ মায়ানমারের যে অঞ্চল হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছচ্ছে, সেখান থেকে জলভাগ বেশি পাওয়া যাবে না। ফলে শক্তিবৃদ্ধি হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা এক্ষেত্রে কম। বড়জোর নিম্নচাপ হতে পারে। এই ঘূর্ণাবর্তই যদি আন্দামান সাগরে সৃষ্টি হত, তাহলে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকত।”
ইদানীংকালেই এরকম উদাহরণ একাধিক। যেমন: ‘পিলিন’, ‘হুদহুদ’, ‘ফণী’, ‘বুলবুল’, ‘আমপান’। এদের বেশ কয়েকটির পূর্বসূরিই আবার ‘নোরু’র মতো দক্ষিণ চিন সাগর বা ফিলিপিন্স সাগর-জাত। ফলে বাংলায় চিনা-বর্ষাসুরের কুনজর একেবারে বিরল, সে কথা বলা যায় না।
ইতিহাস যাই-ই বলুক, বাঙালির এখন একটাই তপস্যা—৫ হাজার কিলোমিটার পথ পেরোনোর আগেই দিগভ্রষ্ট হোক অসুর। কিন্তু সেটা আদৌ হবে কি? ঘূর্ণাবর্তকে কি ঘোল খাওয়াতে পারবেন উমা?