মানব পাচারে বাংলা প্রথম! নাড্ডার দাবিতে সত্যতা কতটা?

জেপি নাড্ডা বলছেন, মানব পাচারে বাংলা প্রথম। কিন্তু এনসিআরবি তথ্য বলছে অন্য কথা। তাহলে ধোঁয়াশা কোথায়? বিশেষজ্ঞরা কি নাড্ডার মন্তব্যকে সমর্থন করছেন?

মানব পাচারে বাংলা প্রথম! নাড্ডার দাবিতে সত্যতা কতটা?
গ্রাফিক্স: TV9 Digital
Follow Us:
| Updated on: Feb 12, 2021 | 5:36 PM

কলকাতা: আজও টিনাকে (নাম কাল্পনিক) দিল্লির তস্য গলির পতিতালয়ে জীবনপাত করতে হত, যদি না সে দিন সাহস করে অভিযোগ জানাতেন স্থানীয় পুলিস স্টেশনে। আজ হয়ত দিল্লি থেকে পাচার হয়ে চলে যেতেন নেপাল কিংবা মালয়েশিয়া। তখন তাঁর অন্তর্ধান রহস্যের কিনারার সাধ্যি শার্লক হোমসেরও হয়তো থাকত না। দশ হাত ঘুরে দার্জিলিং থেকে দিল্লি পৌঁছনো বছর পঁচিশের টিনার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা প্রতিবেদন হিসাবে প্রকাশিত হয় ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে। এমন কত টিনা প্রতিদিন এই বাংলা থেকে ভিন রাজ্যে তথা ভিন দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্টে এর সংখ্যা বাড়ল কি কমল, বাস্তবের তাঁদের কিছু এসে যায় না। তবে, এসে যায় রাজনৈতিক নেতাদের। ভোটের মুখে পশ্চিমবঙ্গে কয়লা, গরুর সঙ্গে মানব পাচার এখন জ্বলন্ত ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানব পাচারে পশ্চিমবঙ্গ কোথায় দাঁড়িয়ে? কেনই বা এই ইস্যু ভোটের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াল? আদৌ কি বাংলা মানব পাচারের ‘আঁতুড়ঘর’ হয়ে উঠেছে? প্রশ্ন গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে সদ্য বাংলা সফরে আসা বিজেপির রাজ্য সভাপতি জে পি নাড্ডার মন্তব্যে।

গত মঙ্গলবার তারাপীঠের চিলার মাঠে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা বলেন, ‘বাংলায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচার হয়। ৩০ শতাংশ গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ মহিলারাই শিকার।’  মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। কিন্তু আদৌ কি বাংলা মানব পাচারে প্রথম? প্রশ্ন উঠছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে মানবপাচারের সংখ্যা মাত্র ১৭২। দু’বছর আগে সে সংখ্যাটা ছিল ৩৫৭৯। ২০১৭ সালে এক ধাক্কায় নেমে দাঁড়ায় ৩৫৭। সর্বশেষ রিপোর্ট হাতে না পেলেও, এনসিআরবি তথ্য বলছে, মানব পাচারে ব্যাপক হারে ক্রমহ্রাসমান পশ্চিমবঙ্গ। তবে, যেখানে ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় মানব পাচারে এগিয়ে রয়েছে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, অসমের মতো রাজ্যগুলি, সেখানে কেন জেপি নাড্ডা এই প্রশ্ন তুললেন?

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য

সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ার দরুন পাচার বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এ রাজ্যের কাছে। ২০১৬ সালে যে নজিরবিহীন সংখ্যা এনসিআরবি-র তথ্যে রয়েছে, তা মমতা সরকারের জমানাতেই। ক্ষমতা আসার প্রথম পাঁচ বছর অতিক্রমের পর ২০১৬-তে মানব পাচারে প্রথম স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। এরপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণে এসেছে, এমনটাই বলছে পরিসংখ্যান। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, জে পি নাড্ডা বলতে চেয়েছেন, তৃণমূলের শাসনকালে সামগ্রিক ভাবে মানব পাচারে এগিয়ে রয়েছে বাংলা। পাশাপাশি, যে হারে মানব পাচার কমেছে বলে জানাচ্ছে পরিসংখ্যান, তা বাস্তবক্ষেত্রে মানতে নারাজ সমাজকর্মীদের একাংশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সমাজকর্মী বলেন, “মানব পাচার আপনার চোখের আড়ালে প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাচ্ছে। এটা একটা সিন্ডিকেটেড ক্রাইম। সে সংখ্যা প্রচুর।” তাঁর মতে, “সাম্প্রতিক রিপোর্ট হাতে না থাকলেও, আমাদের কাছে যা খবর আছে, লকডাউনে মানব পাচার অভাবনীয় ভাবে বেড়েছে। কাজ খুঁজতে গিয়ে ফাঁদে পড়ছে মেয়েরা। প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেখা যাচ্ছে, কোথাও না কোথাও মেয়েদের উদ্ধার করা হচ্ছে।” ওই সমাজকর্মী বলেন, “আমার ব্যক্তিগত মত, লকডাউনে হিউম্যান ট্রাফিকিং ব্যাপক হারে বেড়েছে। জানি না কী করে রোধ করা সম্ভব।”

তা হলে প্রশ্ন, এনসিআরবি-র তথ্য কি তাহলে ভুল? এ প্রসঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কাজ করা আরও এক সমাজকর্মী (ইনিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “এনসিআরবি রিপোর্ট হয় বিভিন্ন রাজ্যের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। প্রতিদিন যে মিসিং ডায়েরি হয়, তা হিউম্যান ট্রাফিকিং হিসাবে ধরে না। মিসিং চিলড্রেনও কোনও না কোনও রকমভাবে হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের মধ্যে পড়ে।” তিনিও মনে করেন, লকডাউনে মানব পাচারের সংখ্যা নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। ওই সমাজকর্মীর কথায়, “লকডাউনে অর্থনীতি যেহেতু তলানিতে ঠেকেছে এবং গণপরিবহণ স্তব্ধ হয়ে যায়, তাই বোঝা যাচ্ছিল না কত সংখ্যক হিউম্যান ট্রাফিকিং হয়েছে। কিন্তু আমাদের হোমে যখন মেয়েরা আসতে লাগল, তখন আন্দাজ করতে পারি আমরা। লকডাউনের আগে যেখানে গড় ২০ টা মেয়ে আসত, এখন বেড়ে কমপক্ষে ৭০-৭৫ হয়েছে।” টিনাদের মতো মেয়েদের কাছে লকডাউন অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে, এ কথা মানতে দ্বিধা করছেন না সমাজকর্মীরা। তবে বাংলা মানব পাচারে প্রথম কিনা সংশয়ে তাঁরা।