‘তালিবরা যখন কাবুলে ঢুকে পড়ল, বাড়িতে একটাও হিজাব ছিল না’ কাবুলিওয়ালার দেশের হাড় হিম করা গল্প

Zarlasht Wali : এই দেশটাই তো জ়ারলাশ্টকে সবকিছু দিয়েছে -- শিক্ষা, স্বাধীনতা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো.. সব। আর যখন দেশের সবথেক বেশি প্রয়োজন, তখন দেশকে একা ফেলে চলে যাওয়াটা বেইমানি বলেই মনে করেন বছর ছাব্বিশের এই তরুণ সমাজকর্মী।

'তালিবরা যখন কাবুলে ঢুকে পড়ল, বাড়িতে একটাও হিজাব ছিল না' কাবুলিওয়ালার দেশের হাড় হিম করা গল্প
কাবুলে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন জ়ারলাশ্ট ওয়ালি
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 14, 2021 | 5:42 PM

কাবুল : সবকিছু কেমন নিমেষের মধ্যে বদলে গেল। এখনও পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারছেন না বছর ছাব্বিশে জ়ারলাশ্ট ওয়ালি। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেয়েটার চোখেমুখে শুধুই আতঙ্ক। বাড়ি থেকে দু’পা বাইরে রাখতে গেলই মাথায় কে যেন সজোরে গুঁতো মেরে মনে করিয়ে দেয়, হিজাবটা পরেছিস তো!

জ়ারলাশ্ট কিছু বুঝে ওঠার আগে সব কিছু পাল্টে গিয়েছে। তিনি এখন শুধু এটুকু বোঝেন, তিনি আর নিজের দেশেই সুরক্ষিত নন। পুরো দুনিয়াটাই যেন উল্টে পাল্টে গিয়েছে জ়ারলাশ্টের জন্য।

জ়ারলাশ্টের জন্ম আফগানিস্তানের গজ়নি প্রদেশে। তবে কর্মসূত্রে থাকেন কাবুলে। কাবুলের এক স্কুলে পড়ান তিনি। মোল্লা ওমরের আমলে জ়ারলাশ্ট খুবই ছোট। বছর ছাব্বিশের মেয়েটার কাছে তালিবান ছিল গল্পের বইয়ের ভিলেনের মতো। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ভুল ভাঙল। গল্পের বইয়ের দানবরা বেরিয়ে এল কাবুলের রাস্তায়। ১৫ অগস্টের প্রতিটি স্মৃতি জ়ারলাশ্টের কাছে বীভিষিকার মতো।

১৯৯৬-২০০১ সালে যখন তালিবানের ভয়ে কাঁপত আফগানিস্তান, তখনকার কথা খুব একটা মনে নেই তাঁর। তখন গুটি গুটি পায়ে বাড়ির ভিতরে ঘুরে বেরাত। আর মাঝে মাঝে তালিব দানবদের গল্প শুনত বাড়ির বড়দের কাছে। জ়ারলাশ্ট বলছেন, “আমি বাড়ির বড়দের থেকে তালিবানের গল্প শুনেছি। এমনকী যখন তালিবরা কাবুলের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, তখনও আমি বিশ্বাস করিনি ওরা এত সহজে সবকিছু দখল করে নেবে। আমি ভেবেছিলাম, আমাদের সরকার, আমাদের সেনা কিছু নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।”

জ়ারলাশ্টের ছোটবেলায় সবাই তাঁকে তালিবান রাজের ভয় দেখাতেন। যাঁরা যাঁরা তালিবানের আগের শাসন দেখেছেন, সবাই কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে যেতেন নাম শুনলেই। পুরানো শাসনকালের স্মৃতি এতটাই কালো, অন্ধকার যে জ়ারলাশ্টের বাড়ির লোকেরা ১৫ অগস্টের পর ভয়ে মেয়েকে দু’দিন বাড়ি থেকে বেরোতে দেননি।

জ়ারলাশ্ট বড় হয়েছে তালিবান পরবর্তী যুগে। সেই সময় চারিদিকে মার্কিন সেনা। মেয়েরাও হিজাবের তোয়াক্কা করত না। ১৫ অগস্ট যখন তালিবরা কাবুল দখল করল, তখন তো জ়ারলাশ্টের বাড়িতে কোনও হিজাবই ছিল না। জ়ারলাশ্ট আধুনিক যুগের মেয়ে। আধুনিক পোশাক পরে অভ্যস্ত, যার দৈর্ঘ্য দেখলে হয়ত যে কোনও তালিব নেতা ভিরমি খাবে।

কিন্তু কাবুলের পরিস্থিতি কী, তা জানার উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছিল. আর বাড়িতে বসে থাকতে পারছিলেন না জ়ারলাশ্ট। তাই একটা লম্বা দৈর্ঘ্যের শীতের পোশাক গায়ে চাপিয়েই বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়।

এর আগে কখনও তালিব যোদ্ধাদের সামনা সামনি দেখননি জ়ারলাশ্ট। খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল তাঁর, কেমন দেখতে হয় তালিব যোদ্ধারা। যেমন ভয়ঙ্কর শুনেছে,তেমনই? বাড়ির বড়রা ভেবেছিলেন, যে ধরনের পোশাক জ়ারলাশ্ট পরেন, তা ভালভাবে নেবে না তালিবরা। মেয়ের উপর আক্রমণ করতে পারে তালিবান। সেই ভয়ে বারণও করেছিলেন একাধিকবার বাড়ির বাইরে বেরোতে।

শেষ পর্যন্ত বাড়ির বাইরে পা রাখল জ়ারলাশ্ট। কিন্তু তালিব যোদ্ধারা সব কোথায়? কোথাও তো দেখা যাচ্ছে না। জ়ারলাশ্ট এগোতে থাকল রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে। সেই দিকে এগোতেই তালিব যোদ্ধাদের দেখা পান তিনি। গল্পের বইয়ের সেই ভিলেনগুলোকে আজ সামনাসামনি দেখছেন তিনি। ঠিক যেমনটা বড়রা ভয় দেখিয়ে এসেছেন তালিবদের নিয়ে, তার থেকেও ভয়ঙ্কর। জ়ারলাশ্ট জানিয়েছেন, “তারা আমাকে আক্রমণ করেনি। কিন্তু ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। গোটা রাস্তাটা আমি ভয়ে ভয়ে হেঁটেছি। সব সময় ভাবছিলাম, এই বুঝি পিছন থেকে আমায় আক্রমণ করল। আমি শুধু আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছিলাম আমাকে সাহায্য় করার জন্য। আমি কোনওদিন ভাবিনি নিজের দেশে হাঁটতে গিয়ে আমি এতটা ভয় পাব। তালিবান ক্ষমতায় আসার ২০ দিনের মধ্যে পুরো জীবনটাই ওলট পালট হয়ে গিয়েছে। ওরা বলছে, ওরা আর আগের মতো নেই। কিন্তু হাবে ভাবে তা মনে হচ্ছে না।”

তবে আফগানিস্তান ছেড়ে পালাতে চান না জ়ারলাশ্ট। এই দেশটা তাঁর কাছে খুব প্রিয়। খুব কাছের। আফগানিস্তানের মাটির গন্ধে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাই আশা ছাড়ছেন না তিনি। জ়ারলাশ্ট সেই হাতে গোনা গুটিকয়েক আফগানের মধ্যে একজন, যাঁরা বিশ্বাস করেন পরিবর্তন আনা সম্ভব। যাঁরা মনে প্রাণে শপথ করেছেন, তালিবানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার।

তাই কাবুল বিমানবন্দরে যখন হাজার হাজার মানুষের ভিড়, তখনও সেই মুখো হননি তিনি। জ়ারলাশ্ট জানিয়েছেন, “আমি একজন শিক্ষক। একজন সমাজকর্মী। আমি আরও অনেকজনের কাছে আশা। যখন সবাই দেশ ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন, তখন আমার মাথায় একটাই কথা আসছে, এই দেশটা আমার। যে মানুষগুলো এখানে থেকে যাচ্ছেন, তাঁরাও আমার আপন। আমি এদের ছেড়ে যেতে পারি না।”

সত্য়িই তো! এই সময় জ়ারলাশ্টের মতো আরও মানুষের প্রয়োজন আফগানিস্তানের। অনেকে বলেও ছিলেন জ়ারলাশ্টকে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। বলেছিলেন, সময় পাল্টে গিয়েছে। এখানে আর কেউ নিরাপদ নয়। কিন্তু এই দেশটাই তো জ়ারলাশ্টকে সবকিছু দিয়েছে — শিক্ষা, স্বাধীনতা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো.. সব। আর যখন দেশের সবথেক বেশি প্রয়োজন, তখন দেশকে একা ফেলে চলে যাওয়াটা বেইমানি বলেই মনে করেন বছর ছাব্বিশের এই তরুণ সমাজকর্মী।

বলছেন, সবাই যদি পালিয়ে যায়, তাদের দেশকে বাঁচাবে কে? কোনও দেশই আফগানিস্তানের সব নাগরিককে জায়গা দিতে পারবে না। সেটা সম্ভবও নয়। তাই আমরা কয়েকজন এখানে থেকে গিয়ে দেশকে আবার আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি ।

আরও পড়ুন : Afghan Women: ইউনিভার্সিটির মুখও দেখতে পাবে না! ভয় দেখিয়েই ফতোয়ায় সমর্থন করতে বাধ্য করল তালিবান