‘ব্ল্যাক ডেথ’ থেকে জন্ম আজকের কোয়ারেন্টাইনের!

ব্ল্যাক ডেথ নামে পরিচিত বুবোনিক প্লেগ ইউরোপের একাধিক শহর উজার করে দিয়েছিল। ১৩৪৩ খ্রিষ্টাদ্বে এই মহামারী শুরু হয়। ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াশ মানুষের মৃত্যু হয়।

'ব্ল্যাক ডেথ' থেকে জন্ম আজকের কোয়ারেন্টাইনের!
১৯০৫ সালে ডিপথেরিয়া মহামারীর সময় এই ছবি। ওসলোর উলেভাল হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইনে থাকা রোগীদের
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jun 13, 2021 | 1:19 PM

১৯০৫ সাল। সুইডেন থেকে বেরিয়ে পুর্নজন্ম হয় সূর্যোদয়ের দেশের। রাজা হ্যাকন সেই প্রথম নিজের দেশে পা রাখেন। শপথ নেন নরওয়ের সংসদ ভবনে। ইতিহাসের পাতায় এই বছর নরওয়ের কাছে শুধু স্বাধীনতা পাওয়ার জন্যই স্মরণীয় নয়, আর একটি কারণেও মনে রাখা হবে। তা হল মহামারী। ডিফথেরিয়ায় শিশুর মৃত্যু মিছিল। অ্যান্টিবডির ব্যবহারের চল তখনও শুরু হয়নি। অনুমানের উপর ভিত্তি করে সংক্রমণের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বাধ্য হয়েই শিশুদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতেন চিকিৎসকরা। হাম, ডিফথেরিয়া, কলেরার মতো রোগ যখন মহামারীর আকার নেয়, সংক্রমণ রুখতে সে দিনও রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার নিদান দিতেন চিকিৎসকরা। বোঝাই যাচ্ছে, করোনাকালে কোয়ারেন্টাইন শব্দের যে প্রতুল চর্চা, তা কিন্তু নতুন নয়। খ্রিষ্টপূর্ব সাতশো বছর আগেও এই কোয়ারেন্টাইন শব্দের চল ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আদিম পন্থা বলে মনে করা হয় কোয়ারেন্টাইন।

কোয়ারেন্টাইনের মানে?

কোয়ারেন্টাইনের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘পৃথকীকরণ’। আসলে একটা নির্দিষ্ট সময়কে বোঝানো হয় কোয়ারেন্টাইন। ভেনিতিয়ান ভাষায় কোয়ারান্তেনা বলা হয়। যার অর্থ ৪০ দিন। চতুর্দশ খ্রিষ্টাব্দে রোমের আঞ্চলিক ভাষা ভেনিতিয়ানে এই শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কোয়ারেন্টাইনের ভাবনার কথা উল্লেখ রয়েছে লেভিটিকাস নামক বইয়ে। খ্রিষ্টপূর্ব সাতশো বছর আগে এই বইটি লেখা হয়। জারাথ (Tzaraath) নামক চর্মরোগের ছোঁয়াচ এড়াতে রোগীকে আইসোলেশনে রাখা হতো।

কোয়ারেন্টাইনের জন্ম:

ব্ল্যাক ডেথ নামে পরিচিত বুবোনিক প্লেগ ইউরোপের একাধিক শহর উজার করে দিয়েছিল। ১৩৪৩ খ্রিষ্টাদ্বে এই মহামারী শুরু হয়। ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াশ মানুষের মৃত্যু হয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সেই প্রথম কোয়ারেন্টাইনের সিদ্ধান্ত নেয় ভেনিতিয়ান প্রশাসন। সে দেশের বন্দর শহর রাগুসায় (বর্তমানে ডুব্রোভনিক, ক্রোয়েশিয়া) ‘ট্রেনটিনো’ নামে একটি আইন জারি করে, বন্দরে যে সব জাহাজ আসবে অন্তত ৩০ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে সবাইকে। এমনকী যারা নিয়ম লঙ্ঘন করে জাহাজ পরিদর্শনে যাবে, তাদেরও ৩০ দিন কোয়ারেন্টাইন থাকতে হবে। প্লেগ আটকাতে এই নিয়ম বেশ সাড়া পড়ে ইউরোপে। মারসেলিস, পিসা-সহ একাধিক শহরও এরপর আট দশক এই নিয়মকে মেনে চলেছে। বেশ কিছু শহর আবার ৩০ দিনের বদলে ৪০ দিন আইসোলেশনে থাকার নিয়ম করে। যাকে ‘কোয়ারান্তেনা’ বলা হত। সেখান থেকে ইংরাজিতে ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দ আসে।

কেন ৪০ দিন কোয়ারেন্টাইন?

এই ৪০ দিন কোয়ারেন্টাইনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে বাইবেলে। মনে করা হয়, জিডিয়ান মরুভূমিতে ৪০ দিন রাত কাটিয়েছিলেন জিশু। সে সময় অশুভ শক্তি তাঁকে নানা ভাবে প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু সেই ৪০ দিন অনশন করে সাতানের নানা প্রলোভন থেকে বিরত থেকেছেন তিনি। জিশুর এই আধ্যাত্মিক লড়াই দিন কোরেন্টাইনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, বিজ্ঞানীর মনে করেন, সে সময় রোগের উপসর্গের দিন সঠিক ভাবে না চিহ্নিত হত না বলে ৩০ দিনের বদলে ৪০ দিন বা ৫০ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দিতেন চিকিৎসকরা। ইতিহাসবিদের একাংশ মনে করেন, কোয়ারেন্টাইন নিয়ে সে সময় এক প্রকার ব্যবসা চালু হয়ে গিয়েছিল। অনেকে টাকা দিয়ে কোয়ারেন্টাইন থেকে মুক্তি পেতে চাইতেন। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোয়ারেন্টাইনকে আরও কড়াকড়ি করে প্রশাসন। যাতে এই নিয়ম না মানতে পেরে টাকা দিতে বাধ্য হয় রোগীরা। তাই বেশিরভাগ সময় গরিবদেরই কোয়ারেন্টাইনে থাকতে দেখা গিয়েছে বলে মত ইতিহাসবিদদের।

কোয়ারেন্টাইন পলিসি

১৩৪৩ খ্রিষ্টাদ্বে বুবোনিক প্লেগের সময় প্রথম কোয়ারেন্টাইন নিয়ে সরকারি পলিসি তৈরি করে ভেনিতিয়ান প্রশাসন। আমেরিকায় হলুদ জ্বরের প্রকোপ বাড়ায় ১৮৭৮ সালে ন্যাশনাল কোয়ারেন্টাই অ্যাক্ট জারি হয়। এই আইন আরও কড়াকড়ি হয় ১৮৯২ সালে কলেরা মহামারীর পর। ১৯২১ সালের মধ্যে এই আইনকে গোটা দেশে কার্যকর করতে সক্ষম হয় আমেরিকা।

করোনা মহামারীকে মোকাবিলা করার এখনও একমাত্র ওষুধ কোয়ারেন্টাইনই। ভ্যাকসিন মৃত্যুর হার কমাতে পারে, সংক্রমণ নয়। আর এই আশঙ্কা থেকেই গবেষকরা মনে করছেন, আগামী এক দশকও কোয়ারেন্টাইন থেকে নিস্তার নেই এই পৃথিবীর। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এখনও শেষ হয়নি। তার আগেই শিয়রে অপেক্ষারত তৃতীয় ঢেউ। তাই ফের কোয়ারেন্টাইনের গল্প দিয়ে বাঁধ মেরামতির কাজে নেমে পড়ার সময় এসে পড়েছে আমাদের।

আরও পড়ুন: ‘এমন আমি ঘর বেঁধেছি…’ করোনা এড়াতে গাছে নিভৃতবাস সাধুর!