শিলিগুড়ি: প্রায়শই বলা হয় বাঙালিরা নাকি ব্যবসা করতে পারে না। কারণ তারা কঠোর পরিশ্রম করতে চায় না। কিন্তু, উত্তরবঙ্গের এক প্রান্তিক গ্রমের, সামান্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ এক ছেলে এই কথাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তাঁর স্বপ্ন এবং অধ্যবসায়কে কাজে লাগিয়ে মাত্র, ১০০ টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। তিনি মলয় দেবনাথ, দেবনাথ ক্যাটারার্স অ্যান্ড ডেকরেটর্সের মালিক। ক্যাটারিং ব্যবসার পাশাপাশি ছয়টি ট্রেনে প্যান্ট্রি কার পরিচালনা করে তাঁর সংস্থা। চা বাগান-সহ সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর বিভিন্ন সম্পত্তি। আর বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, এর শুরুটা হয়েছিল মাত্র ১০০ টাকা থেকে। আসুন জেনে নেওয়া যাক সফল বাঙালি ব্যবসায়ী মলয় দেবনাথের সাফল্যের কাহিনি। কে জানে, হয়ত এটা আপনাকেও অনুপ্রেরণা জোগাবে।
১৯৩৫ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছিলেন মলয় দেবনাথের ঠাকুর্দা। তাঁদের পরিবার ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার, তাঁতের ব্যবসা ছিল। গ্রামের অভাবি শিশুদের জন্য স্কুল তৈরি করতে, তিনি জমিও দিয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের পরিবারকে অত্যন্ত সম্মান করত। সেই স্কুল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, মলয় দেবনাথের জীবনটা মসৃণ ছিল না। তাঁর যখন মাত্র ৬ বছর বয়স, সেই সময় রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তাঁদের তাঁত কারখানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তাঁদের ব্যবসা। যদিও তাদের পরিবার ফের তাঁতের ব্যবসা শুরু করেছিল, কিন্তু, কখনই আগের অবস্থা ফেরেনি।
গত শতাব্দীর আটের দশকের প্রথম দিকে, ব্যবসা বন্ধ করে মলয় দেবনাথের বাবা হন্যে হয়ে কাজ খোঁজা শুরু করেছিলেন। বাড়িতে মলয় ছাড়াও ছিলেন তাঁর দিদি এবং তাঁর দুই ছোট ভাই। সকলেই তখনও স্কুলে পড়ত। মলয় দেবনাথ, স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি, গ্রামে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান চালাতেন। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরই অবশ্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে, মায়ের কাছ থেকে একটি ১০০ টাকার নোট নিয়ে পাড়ি দেন দিল্লিতে। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯।
রাজধানীতে এসে দেবনাথ এক ক্যাটারিং সংস্থায় কাজ নিয়েছিলেন। সামান্য টাকায় দিন-রাত খাটতে হত। কাজ ছিল, থালা-বাসন পরিষ্কার করা, টেবিল পরিষ্কা করার। তবে, তিনি ভেঙে পড়েননি। বুঝেছিলেন তাঁকে লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য কোথাও থেকে একটা শুরু করতে হবে। অত্যধিক কাজের চাপে, তাঁর সহকর্মীদের অধিকাংশই কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, কঠোর পরিশ্রম করে ওই ক্যাটারিং সংস্থার মালিকের ভালবাসা এবং সম্মান অর্জন করেছিলেন মলয়। যার জোরে, মাত্র এক বছরেই তাঁর বেতন মাসে ৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, তারপরও বাড়িতে কোনও টাকা পাঠাতে পারতেন না। এর ওভারটাইম করতেন তিনি। দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন।
এরপর, দিল্লির এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মে সুপারভাইজার পদে যোগ দেন মলয় দেবনাথ। একই সঙ্গে, ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টের একটি কোর্স করেছিলেন তিনি। এই ইভেন্ট সংস্থায় কাজ করার সময় মলয় দেবনাথ অনেক নতুন বন্ধু পয়েছিলেন। যাঁরা পরে তাঁকে তাঁর নিজস্ব ক্যাটারিং সংস্থা চালু করতে সাহায্য করেছিল। সংস্থাটি অনেক বড় পার্টি আয়োজন করত। এর মাধ্যমে তাঁর আতিথেয়তা ব্যবসার জ্ঞান যেমন বেড়েছি, তেমনই বেড়েছিল যোগাযোগ। আর এরপরই শুরু করেছিলেন তাঁর নিজস্ব ব্যবসা দেবনাথ ক্যাটারিং অ্যান্ড ডেকরেটর্স। মলয় দেখিয়ে দিয়েছেন, বাঙালিরাও কঠোর পরিশ্রম করতে পারে।
বর্তমানে, তাঁর সংস্থা দিল্লি, পুনে, জয়পুর, আজমের এবং গোয়ালিয়র-সহ ভারতীয় সেনার ৩৫টিরও বেশি ঘাঁটিতে মেস চালায়। উত্তরবঙ্গে একের পর এক চা বাগান কিনেছেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদ তৈরি করেছেন তিনি। তাঁর দুই মেয়ে এখন পুনে ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করে। তবে, এত সাফল্য পেয়েও মলয় দেবনাথের পা রয়ে গিয়েছে মাটিতেই। এখনও খুব সহজ সরলভাবে জীবনযাপন করেন তিনি।