Manoj Mitra: মনোজ মিত্র, বাংলা নাটকের অমূল্য রত্ন, কেমন ছিল তাঁর এই চলার পথ?

TV9 Bangla Digital | Edited By: Tapasi Dutta

Nov 18, 2024 | 12:06 AM

বাঞ্ছারাম আর নেই। সাজানো বাগানের আলো আজ ফিকে। দেবতাদের শাসনের বিরুদ্ধে শোষিতের মুক্তির গান। মঞ্চে যোদ্ধা, কলমে বিপ্লবী। সাহসী গল্পের কারিগর। শ্রদ্ধাঞ্জলি এক কিংবদন্তিকে। মনোজ মিত্র, বাংলা নাটকের অমূল্য রত্ন।

১২ নভেম্বর, ২০২৪। নাট্যজগতে নেমে এল অন্ধকার। জীবন-মন্ত্রের উদযাপন, প্রাণবন্ত বেহালার শব্দ থেমে গেল। জীবনযুদ্ধে হেরে না যাওয়ার সংলাপ মাঝপথে থামিয়েই নামল পর্দা। বাংলার রঙ্গমঞ্চ ডুকরে কেঁদে উঠলো। ৮৫ বছর বয়সে বার্ধক্যের কাছে হার মেনে চলে গেলেন কালজয়ী মনোজ মিত্র। বাঞ্ছারাম। আমাদের সকলের প্রিয় বাঞ্ছারামের মৃত্যুতে তাঁর সাজানো বাগানের অবসন্ন প্রজাপতির চোখে জল। মনোজ মিত্রের জীবন, কালের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধ। তাঁর জীবন বাঞ্ছার বাগানে ছড়িয়ে থাকা কুয়াশার মতই। যাকে ভেদ করে বারবার এসেছে ভোরের আলো।কেমন ছিল তাঁর এই চলার পথ? কীভাবে তাঁর নাটক বারবার শুনিয়েছে জীবনের জয়গান?

অবিভক্ত বাংলাদেশেই ১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। শৈশবের স্মৃতি আঁকড়ে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের জল-মাটি ছেড়ে ১৯৫০-এ চলে আসেন কলকাতায়। কে জানতো বাঞ্ছার ভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকার জেদ শৈশবেই গড়ে উঠছিল মনোজ মিত্রের জীবনে। আসলে বুড়ো বয়সের অসহায়তার ছবি তাঁর যে বড় চেনা। তিনি লিখেছেন, ‘শৈশবে আমার একটা বড় ভয় ছিল। যখন সত্যি সত্যি জ্বরাগ্রস্থ হব, অকেজো, অথর্ব অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বো। সে দুরাবস্থার সামাল দেব কীভাবে?’ কালের নিয়মে জীবনযুদ্ধে পরাজয় হল তাঁর। সমাজবোধ আর স্যাটায়ার এই তো ছিল তাঁর নাটকের মোদ্দা কথা। আজ যখন চলে গিয়েছেন মনোজ মিত্র, হাজারও স্মৃতি ভিড় করে আসছে তাঁর বন্ধুদের মুখে। গান স্যালুটের পর পুড়ে গেল নশ্বর দেহ। কিন্তু জীবন তো নশ্বর নয়! বাংলার নাট্যমঞ্চে মনোজ মিত্রের পায়ের ছাপ অমলিন। কৌতুক, ব্যঙ্গ, বিরহের প্রাণোচ্ছল আবহ সৃষ্টি করেছেন তিনি। রাজনীতির আঙিনায় প্রত্যক্ষ ছাপ রাখেননি। কিন্তু তাঁর অমূল্য সমাজবোধ? তার চেয়ে বড় রাজনীতি আর কীই বা হতে পারে। নাটক। শাসকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যম হল নাটক। কিন্তু এমার্জেন্সির আগেই পশ্চিমবঙ্গের বা দেশের নাড়ি যেন ধরতে পেরেছিলেন মনোজ মিত্র। লুম্পেন-জোতদার-শাসকের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হল স্যাটায়ার। পরপর রচনা করেছিলেন শিবের অসাধ্যি ও নরক গুলজার। শিবের অসাধ্যিতে দেবী দুর্গা রাষ্ট্রনায়িকা। নেতার মুখে সংলাপ দিলেন, ‘জোতদারের ব্যাকিং বহুদূর। দেবতাদেরও কব্জা করেছে। ও ছিদেম, জোতদার শিবেরও অসাধ্যি।’ স্যাটায়ারের মোড়কে রাষ্ট্রের চরম সমালোচনা। তেমনই নরক গুলজার। রাষ্ট্রশক্তির প্রতীক সেখানে ব্রক্ষ্মা। আর নাট্যকার সেখানে ব্রক্ষ্মার বিরোধী। সেখানেও জয় সর্বহারার। মানিকের। ভগবানকে পুনর্জন্মের শাস্তি দিলেন মনোজ মিত্র। গানের কথায় দেখিয়েছিলেন অত্যাচারী শাসকের ঘুম ভাঙানোর দুঃসাহস। চরিত্রের দাবি! ভাঙা গড়ার খেলায় নামতে পিছপা হতেন না মনোজ মিত্র। দামুর দারোগাবাবু। দুঁদে পুলিশ অফিসার কিন্তু ক্ষমাশীল। কৌতুকের আড়ালে মনস্তত্ব নিয়ে কাঁটাছেড়া। শিকড়ের সন্ধানে ফিরে ফিরে আসে। কিনু কাহার থেকে শুধুমাত্র বাঁচতে চাওয়া বাঞ্ছারাম। তাঁদের গল্পের সঙ্গে সহজেই মিশে যায় বাস্তবের অফিসবাবু। রিহার্সাল শেষে রাতের ট্রেনে ফেরা মফস্‌সলবাসী মেয়েটি। কিংবা দেওয়ালে প্রথম নাটকের পোস্টার দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলা নতুন পরিচালক। আজ ‘স্টান্ডিং ওভেশন’ দিচ্ছেন। জীবনমঞ্চের ‘কার্টেন কল’-এ এসে দাঁড়াচ্ছেন একা একজন মানুষ। যিনি স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের, বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার, উপকথার সঙ্গে দিনযাপনের লড়াইকে এক করতে পেরেছিলেন। তাই হয়তো বাঞ্ছার বাঁচার চরম ইচ্ছার জয় হয় বারবার। তাঁর নাটকে, তাঁর জীবনে।