আমতা : আমতায় ছাত্রনেতা (Amta Student Leader Death) আনিস খানের মৃত্যু ঘিরে তোলপাড় হচ্ছে রাজ্য রাজনীতি। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্নচিহ্ন উঠছে। প্রতিবাদ, বিক্ষোভে আলোড়িত হচ্ছে আমতা সহ গোটা রাজ্য। বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম – রাজনৈতিক রং নির্বিশেষে প্রত্যেক শিবির বলছে – নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ সুপারকে ডেকে পাঠানো হয়েছে ভবানী ভবনে। কিন্তু কে এই আনিস খান? যাঁকে ঘিরে উত্তাল হচ্ছে গোটা বাংলা? বছর আঠাশের আনিস খান। বাড়ি হাওড়ার আমতায় সারদা দক্ষিণ খাঁ পাড়া এলাকায়।
বেশ সক্রিয়ভাবেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আনিস খান। শুরুতে বাগনান কলেজে থাকাকালীন এসএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। আগাগোড়া বাম মানসিকতার আনিস শুরু থেকেই বেশ সক্রিয় ছিলেন কলেজ রাজনীতিতে। পরবর্তী সময়ে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর আইসা এবং এআইএফবির সঙ্গে যুক্ত হন।
এই বিষয়ে এসএফআই নেতা সৃজন ভট্টাচার্য বলেন, “আমি আনিসকে অল্প সময়ে যতটুকু চিনেছি, তাতে অত্যন্ত উৎসাহী একজন ছেলে। যে কোনও বিষয়ে যেটা তাঁকে বিবেকের তারণা দিত, যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সে ছুটে যেত। আমতায় স্থানীয় মানুষের বিপদে আপদে থাকত। এই প্রজন্মের ছাত্রদের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠার এক উপাদান তাঁর মধ্যে ছিল। সেইভাবেই তাঁকে আমরা চিনেছি। রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল এবং খুব পিছনে থাকত না। গুটিয়ে যাওয়ার ছেলে নয়। সামনে থেকে মনের কথা খুলে বলার ছেলে ছিল। এই ধরনের কেউ চলে গেলে সামাজিকভাবে এবং ছাত্র আন্দোলনের খুব বড় ক্ষতি হয়।”
উল্লেখ্য, এনআরসি-সিএএ বিরোধিতায় একাধিকবার সামনের সারি থেকে প্রতিবাদ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। নন্দন চত্বরে বাম ছাত্র রাজনীতির অতি পরিচিত মুখ দীপ্সিতা ধরের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল তাঁর আন্দোলনে নেমে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য আইএসএফ-এর সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।
বাম ছাত্র রাজনীতিতে ভীষণ সক্রিয় থাকলেও পরবর্তী সময়ে রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে বেছে নেন আব্বাস সিদ্দিকী – নওসাদ সিদ্দিকীদের ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টে। স্থানীয় সূত্র মারফত খবর, পাড়ায় আইএসএফের সংগঠন বিস্তার করতে বেশ সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এদিকে এলাকায় আগে থেকেই সক্রিয় ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই নিয়ে একটি বিরোধের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল স্থানীয় স্তরে। এর পাশাপাশি, গতবছর একটি রক্তদান শিবিরেও আয়োজন করতে চেয়েছিলেন তিনি, সেই নিয়েও সমস্যা করেছিল স্থানীয় শাসক দলের নেতারা। এই পরিস্থিতিতে ঘটনাটি সাধারণ কোনও খুনের ঘটনা নাকি রাজনৈতিক হত্যা! তা ঘিরেও প্রশ্নচিহ্ন উঠতে শুরু করেছে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বিষয়টি নিয়ে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর উচিত ওখানে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া। সরকারের উচিত ক্ষমা চাওয়া। মানুষের বিক্ষোভ সঙ্গত। এতদিন পুলিশ ঘিরতে যাচ্ছে। রাগ থাকবে না মানুষের!”
আনিসের পরিবার শুরু থেকেই পুলিশকেই দোষারোপ করে আসছে। তাঁদের বক্তব্য, আনিস যে খুন হতে পারে। এমন আশঙ্কা সে নিজেও করছিল। সেই নিয়ে পুলিশের কাছেও গিয়েছিল সে। কিন্তু তারপরেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন মৃত ছাত্রনেতা আনিস খানের পরিবারের লোকেরা। সম্প্রতি আনিসের বাবার এক সঙ্গে আমতা থানার এক পুলিশকর্মীর টেলিফোনে কথোপকথনও প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও সেই অডিয়ো ক্লিপটির সত্যতা যাঁচাই করেনি TV9 বাংলা। সেখানে শোনা যাচ্ছে, আনিসের বাবা টেলিফোনের ওপারে থাকা এক পুলিশকর্মীকে গোটা ঘটনার কথা জানাচ্ছেন। জানতে চাইছেন, থানা থেকে কেউ আসবেন কিনা। অন্যদিকে ওই পুলিশকর্মী আনিসের বাবাকে বলতে শোনা যাচ্ছে – “আমাদের কাছে এই বিষয়ে এখনও কোনও খবর নেই। আপনার যা কিছু অভিযোগ জানানোর আপনি থানায় এসে জানাতে পারেন।”
” রক্ত দিয়ে ব্যানার লিখবো। যত রক্ত লাগে আমার নাও।” আন্দোলনে একথা বলেছিল আনিস। প্রতিবাদী মুখ, আন্দোলনে সামনের সারির ছেলে। বাগনান কলেজে এসএফআই, আলিয়ায় এসে আইসা, এআইএসএফ, এআইএমএমএ একাধিক সংগঠনের হয়ে আন্দোলনে ঝাপিয়েছে আনিস। বুক ঠুকে আন্দোলন করা ছেলে। সে আর নেই। এত সাহসী একটা ছেলে নেই, মানতেই পারছে না সহপাঠীরা।
২০১৫ সালে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় আনিস। ২০১৭ সালে আলিয়ার ৮০ দিনের বেশি চলতে থাকা আন্দোলনের মাধ্যমে সামনের সারিতে উঠে আসে সে। জোর গলায় স্লোগান, তীব্র সাহস, জুনিয়র ছেলেটা এক লহমায় নেতা হয়ে যায়।
২০১৮ সালে এমটেক ছাত্রদের সাসপেন্ড করে আলিয়া কর্তৃপক্ষ। ফের আন্দোলন, পুলিশের চোখে চোখ রেখে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় আনিস খান। ২০১৯ সালে পার্ক সার্কাসে এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে আলিয়ার অন্যতম নেতা ছিল আনিস। যে ছেলেগুলো একসাথে স্লোগান দিয়েছে এক সময়, রাগে তারা ফুসছে। ফুসছে আলিয়া। ডাক দিচ্ছে বৃহৎ আন্দোলনের।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী ছিল আনিস। মেধাবী ছাত্র। এমবিএ নিয়ে পড়াশোনা করেছে। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে, যথেষ্ট সুনাম ছিল তাঁর। শুধু পড়ুয়া হিসেবেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কারও কোনও সমস্যা হলে, ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সাধ্য মতো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া সাজিদুর রহমান বলছেন, “ছাত্রনেতা হিসেবে অত্যন্ত ন্যায় নিষ্ঠ ছিলেন আনিস। যেখানে অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদ করেছেন। তা যে সময়ে, যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন। যে সময় তাঁর এসএফআইয়ের আদর্শকে সত্য মনে হয়েছে, সেই সময় সে এসএফআইকে পাথেয় মনে করেছে। আবার পরবর্তী সময়ে সে আইএসএফ করেছে। বিভিন্ন সময়ে তাঁর যেটা নিজের মতো হয়েছে, সেটাকেই বেছে নিয়েছে। ওর মধ্যে সততা বিষয়টি রয়েছে। ছাত্র হিসেবে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব – অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, তার সে প্রতিবাদ করেছে। তাতে এনআরসি ইস্যু হোক বা ডঃ কাফেল খানের বহিষ্কার হোক বা রোহিত ভেমুলা… প্রতিটি ইস্যুতেই সরব হয়েছে সে।”
শুধু স্কুলেই নয়, নিজের পাড়াতেও একইরকম সুখ্যাতি ছিল মৃত ছাত্রনেতা আনিস খানের। তাঁর মৃত্যুর পর কার্যত ক্ষোভে ফুঁসছেন এলাকাবাসীরা। শুধু নিজের গ্রামই নয়, আশেপাশের গ্রামগুলির মানুষদের প্রয়োজনেও সবসময় পাশে থাকতেন। কারও বিরুদ্ধে কোনও অন্যায় হতে দেখলে, রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা করতেন না। পাশ্ববর্তী গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের কথায়, “মানুষ ক্ষেপে রয়েছে। কারণ আনিস সবসময় সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সবাইয়ের আদরের। আমি গ্রাম প্রধান হিসেবে চাইব যাতে ও সুবিচার পায়।”
আরও পড়ুন : AMTA Student Death: আনিস মৃত্যুতে ফুঁসছে আমতা, পুলিশকে রুখতে একাট্টা হাজার-হাজার এলাকাবাসী