তিস্তা রায় চৌধুরী: তৃণমূলের গড় শালতোড়ায় হাওয়া বদল হয়েছিল ২০১৯ সালেই। প্রায় ১৫ হাজার ভোটে লিড ছিল বিজেপির। স্বভাবতই এই কেন্দ্রের জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন দিলীপ ঘোষরা। কিন্তু খটকাও যে একদম ছিল না তা নয়। শালতোড়া কেন্দ্রে যাঁকে প্রথম দাঁড় করানো হয়েছে, রাজনৈতিক ময়দানে কার্যত আনকোরা। দেহাতি গ্রাম্য গৃহবধূ। বিজেপির অন্দরেই প্রশ্ন ছিল, তিনি কি পারবেন? তবে সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে শালতোড়ায় পদ্ম ফোটান বছর সাঁইত্রিশের চন্দনা বাউড়ি। সম্প্রতি তাঁকে নিয়ে একটি পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। বিধায়ক হিসাবে যে বেতন পেয়েছেন, গরিব লোকেদের বিলিয়ে দিতে চান চন্দনা। তাঁর জীবনের সঞ্চয়ও নাকি এত টাকা কখনও ছিল না। সত্যিই কি তাই? নাকি আর পাঁচটা গুজবের মতো হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে এই পোস্ট? খবরের সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে খোদ চন্দনার কাছেই পৌঁছে যায় টিভি নাইন বাংলা ডিজিটাল। তখন হেঁসেলে খুন্তি নাড়ছেন চন্দনা। আলু ভাজতে ভাজতেই জীবনের ধারাপাত বলতে শুরু করলেন…
সরাসরি প্রশ্ন চন্দনাকে, এত্ত টাকা নিয়ে কী করবেন…!
–(খুন্তি নাড়তে নাড়তে বিধায়ক বলতে লাগলেন) “এত্ত টাকা দিয়ে কী করব। আমার তো তেমন কিছুর দরকার নেই। সত্যিই কিছু ভাবিনি। এতগুলো টাকা দিয়ে গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আমাদের এখানে রাস্তা খুব খারাপ। বর্ষাতে কোমর অবধি জল। কোনও প্রয়োজনে গাড়িঘোড়া পাওয়া যায় না। বেতনের টাকা দিয়ে রাস্তাটা মোরাম বিছিয়ে যা হোক করে একটু ঠিক করতে চাই।”
(এরপর একটু খোঁচার সুরও শোনা গেল) “সরকার তো সাহায্য করতে চাইবে না। গ্রামে হাতে গোনা আট-দশটা ঘর বাদ দিলে সবই কাচা বাড়ি। বর্ষায় থাকা যায় না। তারমধ্যে এ বছর করোনা। আরও সমস্যা। তাই সবার আগে রাস্তাটা ঠিক করব। জানেন, গর্ভবতী মহিলার ডেলিভারি কেসের সময় গাড়িই আসতে চায় না। খাটিয়ায় করে নিয়ে যেতে হয় শহরে। সে কী সম্ভব! (একটু হাঁফ ছেড়ে বলে চললেন) বর্ষায় রাস্তার জল, আর অন্য সময়ে খাবার জলের সমস্যা। গোটা শালতোড়ায় পাইপের পর পাইপ বসানো হয়েছে। জল আসে না। পানীয় জলটাও ঘরে ঘরে কেউ পায় না। এগুলো আমার প্রাথমিক কাজ। বর্ষায় যাদের কাচা বাড়ি, তাদের ত্রিপল দেব ভেবেছি।”
আপনার বাড়িও তো কাচা, সেই বাড়ি পাকা করে তিনতলা করবেন না?
( সাংবাদিকের খোঁচা গায়েই মাখলেন না ) “না, সে সবে বিশেষ ইচ্ছে নেই। আলতো হেসে বিধায়ক বললেন, “প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘর বানাচ্ছি। তাতেই দিন চলে যাবে। ছেলেমেয়ের জন্য চিন্তা আছে বটে, তবে তার চেয়েও বেশি চিন্তা এখানকার অন্য ছেলেমেয়েগুলো নিয়ে। মানুষ নিয়ে। ওদের অনেকের কাচা বাড়ি। বেড়া দিয়ে কোনওরকমে ঘেরা। বর্ষায় আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কেলাই গ্রামে চারজন আবাস যোজনা পায়নি। নাম লেখানো সত্ত্বেও। সরকারের সহযোগিতা পাওয়ার বিশেষ আশা দেখি না। অতএব, যতটুকু যা করতে পারি। আমার তিনতলা বাড়ি না হলেও চলবে। আমি চাই আমার গ্রামের মানুষগুলো খেয়ে পরে বাঁচুক।”
এই যে আপনি বিধায়ক বেতনের টাকা বিলিয়ে দেবেন বলছেন, অনেকেই বলছে এটা আপনার পাবলসিটি স্টান্ট। এই ধারণা কি একদম ভ্রান্ত?
(টিভি নাইন বাংলার প্রতিনিধির প্রশ্নের ধার বাড়ালেও, চন্দনার সেই দেহাতি উত্তর) “অত টাকা সত্যি আমার দরকার পড়ে না। কোনও মানুষকে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। কোনও দৃষ্টান্ত স্থাপনও করতে চাই না। আমি শুধু আমার কাজটা করতে চাই। কতটা পারব জানি না। বিধায়কের দায়িত্ব একটা অনেক বড় দায়িত্ব। ওসব ফেসবুকে কে কী বলল তা জেনে আমার কী হবে! আগামী নিয়ে চিন্তা করি।”
এই সাক্ষাতকারের মাঝে বলে জানিয়ে রাখা ভাল, প্রার্থী হওয়ার সময়ে নির্বাচন কমিশনে চন্দনা বাউড়ি হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর জমানো ৩২ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনও নগদ সম্পত্তি নেই। বিধায়ক হয়ে বেতন কত হতে পারে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাও ছিল না তাঁর। পরে অবশ্য জানতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের বিধায়ক বেতন ছাড়াও বিভিন্ন ভাতা বাবদ ৮২ হাজার টাকা পান। টাকার অঙ্ক শুনেই নাকি হতবাক হয়ে যান চন্দনা। বিধায়কদের জন্য বরাদ্দ অ্যাকাউন্টেই জমা পড়বে সেই বেতন। কিন্তু সেই অ্যাকাউন্টই তৈরি করা হয়ে ওঠেনি চন্দনার।
এ প্রসঙ্গে নিজেই বললেন, “আসলে জানতাম না তো। এমএলএ-দের জন্য কোয়ার্টারের ফর্ম ফিলাপ করতে শেষবার বিধানসভা যাই। তখনই অ্যাকাউন্ট করার কথা বলেছিল। সেদিন আর করা হয়নি। তারপর তো লকডাউন হয়ে গেল। শুনেছি দুমাসের টাকা একসঙ্গে পাব।” অর্থাৎ ৮২ হাজার টাকা ধরে চন্দনার দুমাসের বেতন বাবদ মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা। রিপোর্টারের কাছ থেকে টাকার পরিমাণ শুনেই বললেন, “ওরে বাবা! আচ্ছা, এ টাকায় বোধহয় রাস্তা গোটা হবে না, না? আরও টাকা লাগবে নিশ্চই! দেখা যাক, বাকি টাকাটা কীভাবে জোগাড় করতে পারি। (তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন) “বাবা আমার আদর্শ, ওঁর মতো হতে চাই…”
এত টাকা দিয়ে গাড়ি-বাড়ি-গয়না কিনতে ইচ্ছে করে না, নিজের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা..?
(প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ থমকালেন চন্দনা, তারপর চলে গেলেন ছেলেবেলার স্মৃতিতে) “আমি তো এই গ্রামেই বড় হয়েছি। আমার বাবা সারাদিন কাজ করতেন। শুধু নিজের কাজ নয়, লোকের কাজও। সবাই মুখে মুখে আমার বাবার নাম করত। আমি সেই দেখে বড় হয়েছি। বাবা বলতেন অন্যায় সইতে না, অন্যায় করতে না। আমি সেই কথাটাই মাথায় রাখি। ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ ছেলে মেয়ে নিজেই তৈরি করবে। আমার ভরসায় কেন থাকবে। তবে হ্যাঁ, ওদের পড়াশোনা শেখাতে চাই। চাই ওরা নিজের পায়ে দাঁড়াক।”
পাঠক জেনে রাখুন, চন্দনার স্বামী শ্রবণ বাউড়ি দিনমজুরির কাজ করেন। ৪০০ টাকা রোজ। তিনিও বিজেপি করেন। স্বামী, ছেলে, মেয়ে ছাড়াও রয়েছে বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি। তবে, স্বামী বিজেপির সাধারণ কর্মী আর চন্দনা বিধায়ক, একুশের নির্বাচনের পর এই সুখের সংসারে কি কিছু পরিবর্তন এসেছে? এই কৌতূহল নিয়ে একেবারে বিধায়কের হাঁড়ির খবরে নজর সাংবাদিকের …
আপনি বিধায়ক আর আপনার স্বামী সাধারণ কর্মী! মনোমালিন্য হয়নি? বাড়িতে সকলেই বা মেনে নিলেন কী করে?
(লাজুক হাসি চন্দনার) “না,না সমস্যা হয়নি। আসলে আমরা অনেক বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার তো। পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে যেভাবে এখানে অত্যাচার করা হয়েছে তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে না। দূর থেকে অনেক কিছুই বোঝা যায় না। পরিবারের সকলেই আমায় বিশ্বাস করে, ভালবাসে। সকলের শুভেচ্ছা আশীর্বাদ নিয়েই তো জিতেছি। আমার বাড়ির লোক না থাকলে জিততাম কী করে! ওঁরাই তো আমায় জিতিয়েছে। মিটিং মিছিলে নিয়ে যাওয়া তো আমার স্বামীই করেন। যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে হয়। ওঁ না থাকলে পারতাম কী করে!”
এখন তো কেন্দ্রীয় বাহিনী আপনাকে নিরাপত্তা দেয়, কেমন লাগছে?
(উত্তর দিতে গিয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন) “ওরা আমাদের পাহারা দেয়। বাড়ির কাছেই ওদের থাকার মতো একটা ব্যবস্থা করেছি। কিছুদিন আমাদের সঙ্গেই ওরা খাওয়াদাওয়া করেছে। আসলে এসবের অভ্য়েস বিশেষ নেই তো। অনেক কিছু শিখতে হবে। শেখা বাকি। বুঝে উঠতে পারিনা। লেখাপড়াও বিশেষ করিনি তো।”
আবার পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয় ?
(কিন্তু কিন্তু করে চন্দনা বললেন) “পড়াশোনা করতে তো খুবই ইচ্ছে হয়। উচ্চ মাধ্য়মিক পর্যন্ত পড়েছি। এত বাধা পেয়েছি, মনে হয়েছে যে আর পড়াশোনা করব না। ক্লাস টেনে পড়তেই পড়তেই বাবা মারা গেলেন। ইলেভেনে পড়ার সময় ডায়রিয়া হল। ততদিনে বিয়েও হয়ে গিয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার সময় আমার স্বামী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দিই। এখনও ইচ্ছে করে। কিন্তু আর কী সময় পাব! ঘর সামলে সংসার সামলে মনে হয় আর হয়ে উঠবে না।”
স্কুলের পড়াশোনা হয়নি, রাজনীতির ময়দানে নয়া ইনিংস। শিক্ষাগুরু মানেন কাউকে?
(কোলের ছেলেকে শাসন করতে করতেই চন্দনা বললেন) “আমি যতটুকু শিখেছি দলের থেকে শিখেছি। ভোটের সময়ে শুভেন্দুবাবুকে কাছ থেকে পেয়েছি। ওঁ বহু পুরনো নেতা। ভাল সংগঠক। ওঁর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তাছাড়া এই মাইনের টাকাও কীভাবে খরচ করব, কী কী কাজে লাগানো যায়, সেসব নিয়েও ওঁর সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। শুভেন্দুবাবুকে আমি ভরসা করি।”
ভোটের পর শুভেন্দু আর শালতোড়ায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? কোনও রাজনৈতিক পরামর্শ বা উপদেশ দিয়েছেন কখনও?
“না, ভোটের পর আর আপাতত আসেননি শুভেন্দুবাবু। তবে, যখন যা সাহায্য় চেয়েছি, পেয়েছি। সেসব ভুলব না।”
সদ্যই দল ছেড়েছেন মুকুল রায়। বিজেপির দীর্ঘ দিনের দক্ষ সংগঠকের এভাবে দল ছেড়ে চলে গেলেন তৃণমূলে? কী বলবেন?
-“মুকুলবাবু বড় নেতা ছিলেন, কেন দল ছাড়লেন জানি না। নানাজনে নানা কথা বলে। এসবে কান দিতে ভাল লাগে না। ওঁ ভাল বুঝেছেন তাই গিয়েছেন। এই নিয়ে কথা বাড়িয়ে কী হবে।”
মুকুলবাবুর মতো আপনিও যদি কোনওদিন দল ছেড়ে চলে যান?
(গলা শক্ত করে চন্দনার উত্তর) “প্রশ্নই ওঠে না। একটা সময় ছিল যখন সাইকেলে চড়ে সংগঠন করতাম। নিজের ইচ্ছায় এই দলে এসেছি। কেউ জোর করেনি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকে দেখেছি, কী পরিমাণ সন্ত্রাস হয়েছে এখানে। তারপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দল ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি বিধায়ক পদ হারালেও সাধারণ কর্মী হিসেবে দলে থেকে যাব।”
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে কি এ বার সাংসদ হওয়ার লক্ষ্য?
প্রশ্ন শুনেই আঁতকে উঠলেন চন্দনা। বললেন, “ওরে বাবা! অত পদ নিয়ে আমি কী করব। এই বিধায়ক হয়েছি এই তো অনেক। এই কাজ আগে করি। পাগল নাকি! আমি সাধারণ ভাবেই থাকতে চাই। অত কিছুর দরকার নেই।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেও ইচ্ছে হয় না?
“না, না অত ভাবিনা।”
দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। আদর্শ বা অনুপ্রেরণাও তো হতে পারে আপনার। মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে দেখলে কী বলবেন?
(প্রশ্ন শুনে চন্দনাকে এই প্রথম অকুতোভয় দেখাল) সাফ জবাব- “মুখ্যমন্ত্রী আমার অনুপ্রেরণা নন।”
তারপর বললেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়নি। দেখা হলে বলতাম, মহিলা হয়ে মহিলাদের উপর নির্যাতন চুপচাপ মেনে নেন কী করে? তাঁরই রাজ্য়ে তাঁরই কর্মীরা মেয়েদের উপর এত অত্যাচার করছে। কোনও শাসন নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেভাবে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে, মানুষ মরেছে তারপরে ওঁকে আর অনুপ্রেরণা ভাবতে পারি না। সেইজন্য তৃণমূলে যাইনি। মানুষ নোংরা জায়গায় বসে না।” রুদ্ধশ্বাসে বলে চললেন, “তবে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কিছু আবেদনও আছে। আমার বিধানসভার রাস্তা সারানো থেকে শুরু করে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা। শালতোড়াতে এসব কিছুই হয়নি। সেসব যাতে হয়, তার ব্যবস্থা করব।”
নির্বাচনে জেতার পর সদ্য একটা ফোন কিনেছেন চন্দনা। এর আগে বাড়িতে কোনওদিন মোবাইল ফোন ঢোকেনি। টেলিভিশন সেট ও নেই। তাই যা খবরাখবর চলে সব ওই ফোনেই। এতক্ষণে আলুভাজা তৈরি শেষ। তোড়জোড় শুরু করেছেন লাউ-চচ্চড়ি রাঁধতে। এর মাঝেই পার্টি কর্মীর ফোন বেজে ওঠে। হাতে খুন্তি আর কানে ফোন নিয়ে আবারও একদফা ঘরে বাইরে হেঁসেল সামলানোর লড়াইয়ে নেমে পড়লেন চন্দনা।
আরও পড়ুন: ‘শুধু রাজীব-কুণাল কি বুদ্ধিমান, আমরা সব গরু-ছাগল!’, তোপ কল্যাণের