দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র

পশ্চিমবঙ্গের ৪২ লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হল দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র। স্বাধীনতার পর থেকেই,  এই কেন্দ্রে পৃথক গোর্খাল্যান্ড গঠনের দাবিতে আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়েছিল। তাই স্বাধীনতার পর থেকে বারবারই এই কেন্দ্রের রাজনৈতিক মেজাজ বদলেছে। অধিকাংশ সময় এই কেন্দ্রে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে জাতীয় কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর মধ্যে। ১৯৫৭, ১৮৬২, ১৯৭৭, ১৯৯১,২০০৪ - পাঁচবার বিজয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী। আর সিপিআই(এম) বিজয়ী হয়েছে - ১৯৭১, ১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯ - ছয়বার। মাঝে ১৯৬৭ সালে নির্দল প্রার্থী আর ১৯৮৯ সালে গোর্খা ন্যাশনাল লিগ ফ্রন্টের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে এই লোকসভা কেন্দ্র বিজেপির দখলে। বর্তমান সাংসদ রাজু বিস্তা। এখনও পর্যন্ত এই লোকসভা কেন্দ্রে একবারও জিততে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেস। এবার এই ইতিহাস বদলাতে মরিয়া মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের দল। 

দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে মোট সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র - কালিম্পং, দার্জিলিং, কার্শিয়াং, মাটিগারা-নকশালবাড়ি, শিলিগুড়ি, ফাঁসিদেওয়া, ও চোপরা। কালিম্পং রয়েছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দখলে আর চোপরা তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। একুশের বিধানসভা ভোটে বাকি পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রেই উড়েছে গেরুয়া আবির। দার্জিলিং কেন্দ্র একটি সাধারণ আসন, তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত নয়। এবারের নির্বাচনেও এই কেন্দ্রে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)। দার্জিলিং-র মোট ভোটদাতার সংখ্যা ১৬,১১,৩১৭। ২০১৯-এ ভোট দিয়েছিলেন ১২,৬৭,২৭০ জন। ভোট পড়েছিল মোট ৭৮.৬৫ শতাংশ।

কংগ্রেস বনাম সিপিআই(এম) 

দার্জিলিং নির্বাচনী এলাকা পরিচিত পর্যটন শিল্প এবং চা বাগানের জন্য। প্রাথমিকভাবে এই কেন্দ্রের রাজনীতিও আবর্তিত ছিল চা শ্রমিকদের সংগঠনকে কেন্দ্র করে। প্রাথমিকভাবে শ্রমিক সংগঠনগুলি কংগ্রেসের দখলে ছিল, কালক্রমে তা বাম দিকে ঝোঁকে। লোকসভা কেন্দ্রের ফলাফলেও তার ছাপ পড়েছে। ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে পরপর দুইবার কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিলেন থিওডর মানেন। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস এবং বামেদের পিছনে ফেরে বিজয়ী হয়েছিলেন নির্দল প্রার্থী এম বসু। ১৯৭১ সালের পঞ্চম লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রথমবার জিতেছিল সিপিআই(এম)। প্রার্থী ছিলেন রতনলাল ব্রহ্ম। ১৯৭৭-এ জিতেছিলেন সিপিআই(এম)-এর কৃষ্ণ বাহাদুর ছেত্রী, ১৯৮০ এবং ১৯৮৪-তে সিপিআই(এম)-এর আনন্দ পাঠক।

গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন

গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষদিকে দার্জিলিংয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আন্দোলন। রাস্তার আন্দোলনকে সংসদে পৌঁছে দিতে রাজনৈতিক দল, গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করেছিলআন্দোলনকারীরা। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের ইন্দ্রজিৎ। তারপর অবশ্য গতি হারিয়েছিল এই আন্দোলন। ফের এই কেন্দ্রে দেখা দিয়েছিল বাম-কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

গেরুয়া দার্জিলিং

২০০৮ সাল থেকে ফের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের জেরে অশান্ত হয় পাহাড়। আর এবার গোর্খাল্যান্ডের স্বপ্ন পূরণে গেরুয়া শিবিরের উপর ভরসা করা শুরু করে দার্জিলিং। ২০০৯ সালে তৎকালীন বিশিষ্ট বিজেপি নেতা যশবন্ত সিং-কে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটে সিপিআই(এম) প্রার্থী জিবেশ সরকারকে পরাজিত করেছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এর পরের দুইবার এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন আরও দুই বিজেপি প্রার্থী - এসএস আলুয়ালিয়া এবং রাজু বিস্তা। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে, মোদী হাওয়ায় ৪ লক্ষ ৮৮ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন এসএস আলুয়ালিয়া। নিরটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তথা প্রাক্তন পুটবলার ভাইচুং ভুটিয়া। ভাইচুং পেয়েছিলেন ২ লক্ষ ৯১ হাজারের বেশি ভোট। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তা পান ৪ লক্ষ ১৩ হাজারের বেশি ভোট। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী অমর সিং রাই পেয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার ভোট। এই কেন্দ্রে এখন বাম-কংগ্রেসের ভোট কমতে কমতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে বললেই চলে।