স্নেহা সেনগুপ্ত
সরকারি চাকরি করতেন। কিছুটা দেরি করেই পর্দার ওপারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সন্দীপ রায় থেকে অপর্ণা সেন, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়—অনেকের পরিচালনাতেই কাজ করেছেন। যুক্ত ছিলেন আইপিটিএ-র সঙ্গেও। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পর্দার জন্য আবিষ্কার করেন সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়। নব্বইয়ের দশকে দূরদর্শনের পর্দায় সত্যজিৎ রায় রচিত ‘সাধনবাবুর সন্দেহ’ গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি ছবিতে অভিনয় করেন সন্দীপের পরিচালনায়। তারপর একে-একে আসতে থাকে অন্যান্য চরিত্রের অফার। সন্দীপের প্রায় সবক’টি ‘ফেলুদা’ ছবির অন্যতম অংশ ছিলেন পরাণ। কাজ করেছেন ‘দেখা’, ‘দ্য জ্যাপানিজ় ওয়াইফ’, ‘সিনেমাওয়ালা’, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’, ‘বব বিশ্বাস’, ‘বরুণবাবুর বন্ধু’, ‘টনিক’-এর মতো অগুনতি ছবিতে। আসন্ন অক্টোবরে ৮৩ বছর বয়সে পা দেবেন টলিপাড়ার বর্ষীয়ান অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্ত্রীকে হারিয়েছেন ২০১৯ সালে। সঙ্গীহীন পরাণের জীবন এখন কোন খাতে বইছে? রসিক মানুষটার মনে কতখানি আনন্দ থাকে, খোঁজ নিল TV9 বাংলা।
প্রশ্ন: আপনি কি একা?
পরাণ: ‘একা’ বিষয়টি চিরকালীন। এখন সেটা আরও তীব্র হয়েছে। আগে মানুষ একাকিত্বকে ভবিতব্য বলে মনে করত। এখন তা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুলুক-সন্ধান করতে শুরু করেছে অনেকে।
প্রশ্ন: আপনি নিজেও কি সেই সুলুকের সন্ধান পেলেন?
পরাণ: আসলে একা ফিল করা হল একটা বোধ। সেই বোধ যদি না থাকে, অনুভূতিটাও আর আসবে না। একাকিত্ব অনেকসময় অন্য ভাবনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে হতাশার। যাঁরা পারফর্মিং আর্টসের মধ্যে থাকেন, যাঁরা লেখালেখি করেন, গান-বাজনা করেন, অভিনয় করেন, তাঁরাও একা। এ দিকে, কোনও মানুষ বিবাহ করলে দীর্ঘসময় দ্বৈত জীবনে থাকে। সেখানে যদি কোনও শূন্যতা নেমে আসে, কেউ যদি সময়ের আগে চলে যায়, তখন অদ্ভুত এক ধরনের একাকিত্ব এসে গ্রাস করে। যিনি সেই একাকিত্বের শিকার হন, তাঁকেই খুঁজে বের করতে হয়, এর থেকে আমি কীভাবে পরিত্রাণ পাব। যদিও একাকিত্ব কেউ পূরণ করতে পারে না।
প্রশ্ন: অবসর কেমন করে কাটে?
পরাণ: আমার চোখটা বেশ ঝামেলা করছে। তা-ও খাতা-কলম নিয়ে বসি। যা খুশি তাই লিখি। নাটকও লিখি।
প্রশ্ন: বাড়িতে কে-কে আছেন?
পরাণ: আমার ছেলে আছে, ছেলের বউ আছে। তাঁদের সন্তান আছে। আমার নাতনি। তার বয়স এখন সাত।
প্রশ্ন: তাঁদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
পরাণ: সম্পর্কহীনতা কিংবা মনোমালিন্যের যে উপাদান থাকে, সেগুলি আমার নেই। গোড়া থেকেই নেই। আমার উদ্দেশ্য এটাই, প্রতিদিন যদি দু’জন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, তা হলে আমারই লাভ। আমিই গেইন করি। সুতরাং, বিচ্ছেদের কোনও প্রশ্নই নেই সেই অর্থে। কেউ যদি একটু বিরক্তিকর কথা বলেও, আমি বিব্রত হই না। মনে বিরক্তি আসে না আমার। কেন না, আমার বিরক্তি উদ্রেহকারী বিষয়টিই অকেজো। এ সব করলে খানিকটা গুণ অর্জন করা যায়, আনন্দ করা যায়, তার সঙ্গে কষ্টও হয়। কেউ যদি আমার সঙ্গে মিথ্যাচার করে, কিছু গোপন করে, সেগুলো আমি বুঝতে পারি তাঁর কথার ভঙ্গিমা এবং চোখ দেখে। মিথ্যাচার করলে মানুষের ব্যবহারে তা প্রকাশ পায়। আর যেহেতু আমি অভিনয় করি, সহজেই বুঝে যাই মিথ্যাটা প্রতিস্থাপন করা সঠিক হচ্ছে না।
প্রশ্ন: কীভাবে মিথ্যা কথা ধরে ফেলেন?
পরাণ: দেখবেন, কেউ যখন বানিয়ে কিংবা অসত্য বলে, তাঁর কণ্ঠে কম্পন হয়। সত্যি কথা বলার সময় কিন্তু সেই কম্পন হয় না। সেই কথা তাঁর কণ্ঠ থেকে অতি সহজে বেরিয়ে আসে। মিথ্যা বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন: ২০১৯ সালে স্ত্রীকে হারিয়েছেন…
পরাণ: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: তিনি চলে যাওয়ার পর পরিবারের বাকিরা কতখানি আগলে রাখেন আপনাকে?
পরাণ: দেখুন, এখানে আমার কিছু কথা বলার আছে। অভিনয়ের উদাহরণকেই তুলে ধরছি। অনেক আগে অসংযত এবং আবেগতাড়িত হয়ে অ্যাক্টো করতাম। অভিনয় যখন বুঝে করতে শুরু করলাম, জীবন সম্পর্কে আমার একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল। ফলে, কেউ যখন আমার সঙ্গে ওই ধরনের ব্যবহার করে, তাঁর মনের ভিতরটা আমি দেখতে পাই। আর মনের ভিতর দেখতে পেলে আমার বিশ্লেষণ করতেও সুবিধে হয়। সঠিক উত্তরগুলোও দিতে সুবিধে হয়। তখন যে আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে আসে, তার মনে হয়, এখানে তেমন সুবিধে হবে না।
প্রশ্ন: তার মানে আপনার সঙ্গে কলহ করে তেমন লাভ নেই!
পরাণ: কেবল আজ থেকে নয়। বহু আগে থেকেই আমি কিছু জিনিস প্র্যাকটিস করি। আমি কিন্তু একেবারেই শান্ত মানুষ ছিলাম না। ছিলাম বেশ ডানপিটে। মারকুটেও। কিন্তু যখন আইপিটিএ-তে যোগ দিলাম, একটা ফিলোজ়ফি আমাকে গাইড করতে শুরু করল। সারাজীবন ধরে এখনও পর্যন্ত আমার জীবনে সেটা আছে। কলহ সর্বত্র। মাঠে-ঘাটে সবখানেই। আমি মনে করি, কলহ করে যে সময় ব্যয় হয়, তা আদতে ক্ষতিই করে। তাই সময়কে নষ্ট হতে না দিয়ে যদি ক্রিয়েটিভ কিছু করা যায়, সবদিক রক্ষা পায়।
প্রশ্ন: আর অপমাণিত হলে?
পরাণ: সেই পাওনাও আমি ফিরিয়ে দিই। কিন্তু আমার ফিরিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিমা এমন যে, সেই ব্যক্তি আহত হয় এবং অন্যরা উপভোগ করে।
প্রশ্ন: সেটা কীরকম?
পরাণ: সেটা হয়ে যায় একটা মজার শিল্প। আমার অফিসে এমন কাণ্ড ঘটেছে। পথেও হয়েছে। অফিসে আমার সঙ্গে কারও তেমন বিবাদ ছিল না। কিন্তু যদি কাজের সময় দেখতাম পাশের ঘরে অন্যরা চিৎকার-চেঁচামিচি করছে, আমি গিয়ে বলতাম, “আমি যে পাশের ঘরে কাজ করছি, তাতে তোমাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?” লেখাপড়া জানা ছেলেপুলে তো, এমন কথা শুনে লজ্জায় লাল হতেন। কানে হাত দিয়ে ‘সরি-সরি’ বলতে শুরু করতেন।
প্রশ্ন: এ তো বেশ মজার বিষয়!
পরাণ: শুধু তাই-ই নয়। আরও শুনুন। তখন গাড়ি ছিল না আমার। বন্ধুর সঙ্গে স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলাম। গাড়ি এসে দাঁড়াল। অনেকে উঠল। একটু ভিড়ের মধ্যে একজন গল্প করছিলেন। তাঁর পায়ে জুতো (‘শু’ বলেছেন সাক্ষাৎকারের সময়) আর আমার পায়ে চটি। আমার পাঁচটা আঙুলের উপরে তিনি দাঁড়িয়ে। আমি কলহ না করে বলেছিলাম, “কিছু যদি মনে না করেন, আপনি আমার বাঁ-পা’টা ছেড়ে দিন। আমি ডান পা’টা দিচ্ছি। আপনি দাঁড়ান। কিছুক্ষণ পর বাঁ-পা’টা ফের দেব আপনাকে।” যেই বলেছি, সঙ্গে-সঙ্গে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল তাঁর। কথা বন্ধ হয়ে গেল।
প্রশ্ন: এ তো দারুণ ব্যাপার…
পরাণ: তাই বলছি, এই এতগুলো বছর পরও আমি একই রকম আনন্দে আছি। আমার কোনও দুঃখ নেই। কারও সঙ্গে বিবাদ নেই। কলহ নেই। বিষয়টা ভাল না বলুন!