কোচবিহার: মানুষ। মানুষের রক্তেই শান্তি পান এই দেবী। শুনেই অবাক হচ্ছেন তো? কিন্তু, সত্যি এটাই। এই দুর্গা পূজিত হন মানবরক্তে। তবে এখন আর নরবলি হয় না। তবে নররক্ত দান করা হয়। তাতেই নাকি তুষ্ট হন দেবী। কোচবিহার রাজবংশের দেবী দুর্গা ‘বড়দেবী’ নামে পরিচিত।
প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসা এই পুজোর কিছু ইতিহাস কোচবিহার এবং তার আশপাশের অঞ্চলগুলিতে বেশ প্রচলিত।
আনুমানিক ১৫১০ সালে তৎকালীন কোচবিহারের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসংহের সুযোগ্য পুত্র মহারাজা নরনারায়ণ এই পুজোর প্রচলন করেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মা দুর্গা ‘বড়দেবী’ রূপে অবতীর্ণ হয়ে মহারাজাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে তাঁর পুজো প্রচলন করতে বলেন। কথিত রয়েছে, প্রাচীন গুঞ্জবাড়ির ডাঙুরাই মন্দিরে শ্রাবণমাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ময়না গাছের ডাল দিয়ে এই মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়।
বড়দেবীর চেহারার সঙ্গে ‘কোচ’ জাতির মানুষের চেহারার বেশ কিছু মিলও রয়েছে। প্রাচীন এই পুজোয় দেবীর গাত্রবর্ণ লাল, আকর্ণনয়ন, খর্ব নাশা এবং মুখের আকৃতি খানিক চ্যাপ্টা প্রকৃতির। মায়ের মূর্তি প্রায় ১১ ফুট লম্বা। অসুরের গাত্রবর্ণ এখানে সবুজ। মায়ের সঙ্গে বাহন হিসেবে থাকে সিংহ, বাঘকে। তবে থাকেননা লক্ষ্মী-গণেশরা। বরং, দেবী এখানে নিজের দুই সখী জয়া ও বিজয়া পরিবৃতা।
দেবী এক এক দিন এক এক রূপে পূজিত হন এখানে। আগে নরবলির প্রচলন ছিল। ২৫০ বছর আগে এই প্রথা বন্ধ করেন ১৯তম কোচ মহারাজা নরেন্দ্র নারায়ণ ভূপ, চালু করেন মোষবলি। বড়দেবীর পুজো চলাকালীন সন্ধিপুজোতে মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় গুপ্তপূজা। এই সময় মন্দিরে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র পুরোহিতপ্রধান এবং রাজপরিবারের সদস্যরাই তাতে উপস্থিত থাকতে পারেন। এই গুপ্তপূজা নরবলিকেন্দ্রিক একটি পদ্ধতি। কামসানাইট উপাধি পাওয়া কোনো প্রতিনিধি তাঁর আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন দেবীর চরণে। বিশ্বাস যে, সামান্য হলেও নররক্তেই তুষ্ট হন দেবী। একটি নির্দিষ্ট বংশের পুরুষই এই রক্ত দিয়ে থাকেন, তাই প্রচলিত। চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি প্রতীকী নরমূর্তির বলিও এখানে প্রচলিত।
ষষ্ঠী থেকে সাড়ম্বরে পুজো হলেও মায়ের ভোগে দেওয়া হয় শুধুই পায়েস। সেদিন প্রথা অনুযায়ী ৫টি পাঁঠা বলি হয়। ওইদিন চাল, ডাল, সবজি ও বলির মাংস একত্র করে আমিষ খিচুড়ি মায়ের প্রসাদে দেওয়া হয়। রাজতন্ত্র নেই। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, প্রথা অনুযায়ী দেবী পুজো চলছে। নিয়ম অনুযায়ী বড় দেবীর মূর্তির বিসর্জনের পরই বাকি সব প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। দেবী প্রতিমা বিসর্জন হয় রাজপরিবারের নিজস্ব যমুনা দীঘিতে।
কথিত রয়েছে, পুজোর আগে রাজবাড়ি সংলগ্ন মাঠ থেকে স্বয়ং রাজা হাতির পিঠে চেপে খঞ্জনা পাখি ছাড়তেন। সেই পাখি যেদিকে যেত রাজার ভাগ্য নির্ধারণ হত সেই দিক বুঝে। শেষ স্বাধীন রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভূপের মৃত্যুর পর এই পাখি ওড়ানোর অনুষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়। কোচ রাজবাড়ির অন্দরে রয়েছে এমন নানা বর্ণাতীত কাহিনী। কখনও কখনও বড়দেবীর ‘হোক ভয়ঙ্কর তবু সুন্দর’ রূপের মধ্যেই ফুটে ওঠে সেইসব রূপকথার মতো অতীত।
আরও পড়ুন: Post Poll Violence: সিবিআইয়ের তালিকা থেকে বাদ সুফিয়ান, গ্রেফতার তাঁর জামাই-সহ ১১ তৃণমূল কর্মী