হাওড়া: শুক্রবার রাত! বাড়ির নীচে পড়ে থাকতে দেখা যায় ছাত্রনেতা আনিস খানকে। চাপ চাপ রক্ত ছড়িয়ে চতুর্দিকে। সেদিন থেকে পেরিয়ে গিয়েছে তিন দিন। ঘড়ির কাঁটায় ৮৩ ঘণ্টা। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে যখন প্রথম থেকেই অভিযোগ তুলছিল পরিবার, তখন পুলিশকে সাসপেন্ড করতে লেগে গেল তিন দিন। আনিসের বাড়িতে যে ওই রাতে পুলিশই গিয়েছিল, তা জানা গেল তিন দিন পরেই, তাও আবার সিট-এর তদন্তে। প্রশ্ন উঠছে, ৮৩ ঘণ্টা সময় লেগে গেল তদন্তের গতি এগোতে? এই ৮৩ ঘণ্টা কী করছিল জেলা পুলিশ? তবে কি প্রমাণ লোপাটের যে অভিযোগ তোলা হচ্ছিল, সেটাই সত্যি? জেলা পুলিশ কি তবে সত্যিই কিছু লুকানোর চেষ্টা করছিল? প্রশ্ন থাকছেই।
আনিস রহস্যে পুলিশের ভূমিকায় খটকা
খটকা ১ (মিসিং মোবাইল)
১৯ তারিখ অভিযোগ জানানোর পর পুলিশ কি আদৌ আনিসের মিসিং মোবাইল খোঁজার চেষ্টা করেছিল? করলে পুলিশ আগেই জানতে পারত, মোবাইল আনিসের বাড়িতেই আছে। একুশ তারিখ পরিবারের লোকজন না বলা পর্যন্ত পুলিশ জানতেই পারল না মোবাইল বাড়িতে। মোবাইল ট্রাক করল না কেন পুলিশ?
খটকা ২ (স্কেচ)
কেন তিনদিন কেটে যাওয়ার পরও পুলিশ স্কেচ তৈরি করল না? আনিসের বাবা বার বার বলছেন ওই রাতে যারা এসেছিল তাদের দেখলে চিনতে পারবেন। সেক্ষেত্রে অভিযুক্তদের শণাক্তকরণের কেন চেষ্টা হল না? আনিসের গ্রামে ঢোকার রাস্তায় সিসিটিভি আছে। কেন পুলিশ সেই ফুটেজ চেক করল না। তাহলে জানা যেত ওই রাতে কারা গ্রামে ঢুকেছিল?
খটকা ৩ (সিসিটিভি)
আনিসের গ্রামে ঢোকার রাস্তায় সিসিটিভি আছে। কেন পুলিশ সেই ফুটেজ চেক করলো না। তাহলে জানা যেত ওই রাতে কারা গ্রামে ঢুকেছিলো
খটকা ৪ (উদাসীন পুলিশ)
ভাইরাল অডিও থেকে স্পষ্ট, প্রথমে পুলিশ আদৌ পাত্তা দিচ্ছিল না আনিসের পরিবারের করা অভিযোগ। কেন খুনের অভিযোগ পাওয়ার পরও এত নির্লিপ্ত ছিল পুলিশ। তাহলে কি পুলিশ আগেই সব জানত?
খটকা ৫ (আত্মহত্যা তত্ত্ব)
কেন গ্রামের এক সিভিক ভলান্টিয়ার ঘটনার পর নিজে থেকে মন্ত্যব্য করলো যে আনিস আত্মহত্যা করেছে। শুরু থেকেই আনিসের পরিবার অভিযোগ করেছে ওই রাতে পুলিশ এসেছিল। তার পর কেন জেলা পুলিশ আমতা থানার পুলিশ কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করল না। সিট তদন্ত শুরু করেই প্রথমে পুলিশ কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের ঘটনার দিন মোবাইল টাওয়ার লোকেশন চেক করে।
খটকা ৬ (নজর ঘোরানোর চেষ্টা?)
আনিসের পুরনো মামলা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে পুলিশ। কিন্তু ঘটনার পর চার দিন পেরলেও অধরা অভিযুক্তরা। আসল রহস্যর কিনারা না করতে পারলেও, হঠাৎ কেন জেলা পুলিশ আনিসের পুরোনো মামলা নিয়ে সরব হয়ে উঠল?
খটকা ৭
কেন ঘটনার পর অকুস্থল ঘিরে রাখল না পুলিশ?
এমনিতেই ঘটনাস্থলে পুলিশের দেরি করে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ, ঘটনার পর যে স্থান থেকে আনিসের দেহ উদ্ধার হয়েছে, সেটিকে ঘিরে রাখেনি পুলিশ। সাধারণত যেটা করা হয়ে থাকে।
গত তিন দিন ধরে দেখা গিয়েছে জেলা পুলিশ ‘নিস্পৃহ’। সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর সিট যে কাজটা করেছে, তা হল পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদ। তদন্তের প্রথম দিনই, আমতা থানার পুলিশ কর্তাদেরই জিজ্ঞাসাবাদ করলেন তাঁরা। আনিসের পরিবারের তরফে প্রথম থেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছিল। সেটি স্পষ্ট করতেই প্রথমে এই দিকেই নজর দেন তদন্তকারীরা। ঘটনার দিন থানায় কারা কারা ডিউটিতে ছিলেন, সেটা জানার চেষ্টা করেন তদন্তকারীরা। সোমবার রাত সাড়ে দশটার মধ্যে সিটের ডিআইজি সিআইডি অপারেশন মিরাজ খালিদ, বারাকপুর কমিশনারেটের যুগ্ম কমিশনার ধ্রুবজ্যোতি দে-র তদন্তকারী দল নিয়ে আমতা থানায় পৌঁছয়। টানা চলে জিজ্ঞাসাবাদ।
আনিসের একটা রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে, সেদিক থেকে কোথাও কি পুলিশ অন্য কারোর নির্দেশে এরকম কোনও কাজ করেছে? কারণ প্রাথমিক তদন্তের পর যে রিপোর্ট উঠে আসছে, তাতে এমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি, যাতে জোরালভাবে বলা যায় ওই রাতে পুলিশ সেজে বা পুলিশের পোশাক পরে কেউ ওই বাড়িতে ঢুকেছিল। তদন্তে বলছে, পুলিশই ওই রাতে আনিসের বাড়িতে গিয়েছিল। তবে সাসপেন্ডেড তিন পুলিশ কর্মীই যে আনিসের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। পুলিশ সরকারিভাবে জানিয়েছে, যে ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে, ঘটনার পর আনিসের বাবা বারবার থানায় ফোন করেছিলেন। পরিবারের লোকেরা ফোন করেছেন, কিন্তু পুলিশ ছিল নির্লিপ্ত।
তবে শুধু সাসপেনশনই যথেষ্ট নয়। দোষীদের চিহ্নিত করে যোগ্য শাস্তি দিতে হবে। সিট তদন্ত সত্ত্বেও সিবিআই তদন্তে অনড় আনিসের দাদা সাবির খান। পুলিশি ‘গড়িমসি’ অভিযোগ ক্রমশই জোরাল হচ্ছে। সেক্ষেত্রে পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কি কোনও দায়বদ্ধতা থাকে না এক্ষেত্রে? প্রশ্ন তুলছে পরিবার।