বছর কয়েক আগের ঘটনা। জনপ্রিয় বাংলা চ্যানেলে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের একটি শো হত, ‘অপুর সংসার’। সেখানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত থাকতেন বহু জনপ্রিয় তারকা। একবার জুন মালিয়ার সঙ্গে এসেছিলেন অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ও। ২৪ মার্চ, ২০২২ সালে অকালেই প্রয়াত হন বাংলার জনপ্রিয় নায়ক অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। ৯০-এর দশকে একাধিক বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি। ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘দহন’ ছবিতে অভিষেকের অভিনয় বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। একসময় সিনেমার পর্দায় তাঁর কাজ ফুরোয়। এই শোতেই দুঃখ করে বলেছিলেন, বাংলা সিনেমা তাঁকে আর ডাকে না। তিনি রাজনীতির শিকার। সেই শোতেই নিজের প্রথম ছবি ‘পথভোলা’-এ সুযোগ পাওয়ার স্মরণীয় ঘটনার কথা শেয়ার করেছিলেন অভিষেক।
স্ট্রাগেল-পূর্ণ সেই ঘটনা সম্পর্ক অভিষেক বলেছিলেন…
“প্রতিদিন সকালবেলায় বাইকে নিয়ে পরিচালক নন্দন দাশগুপ্তর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতাম আমাদের ফ্যাক্টরিতে। বিকেলে ক্লাবে ফুটবল খেলার সময়ও ওঁর বাড়ির সামনে দিয়েই যেতাম। আমাকে অনেকদিন পর্যন্ত ফলো করেছিলেন তিনি। আমাকে ওঁর পছন্দ হয়েছিল। ছবিতে একটি ইয়ং পেয়ারের দরকার ছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলায় ফুটবল খেলে হাফ-প্যান্ট পরে খালি গায়ে মাঠের মধ্যে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমাকে এসে বললেন, ‘শোনো এদিকে এসো মিঠু, আমি একটা সিনেমা করছি। তাতে একটা হিরোর রোল আছে, তুমি করবে?’ আমি অবাক হয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি হিরো.. কী বলছেন.. ভেবেচিন্তে বলুন’। বলেছিলেন, ‘না, আমি তোমাকেই চাই…’। বলেছিলাম, ‘দাঁড়ান, বাড়িতে কথা বলে আসি।’ বাবাকে বলার সাহস পাইনি। মাকে বলেছিলাম। মা রাজি। ছেলে হিরো হবে। কোন মা না চান। মা বললেন, ‘যা না ট্রাই কর না, দ্যাখ!’ সেই আমার জার্নি শুরু হল।
কিন্তু আমার জার্নিটা প্রথমদিকে একেবারেই স্মুথ ছিল না। পাঁচ-সাতদিন শুটিংয়ের পর ছবিটা বন্ধ হয়ে যায় টাকা-পয়সার অভাবে। কিন্তু আমার মাথায় পোকা ঢুকে গিয়েছে। স্ট্রাগেল শুরু হয়। আমি নতুন ছেলে। আমাকে কে পাঠ দেবেন। দরজায়-দরজায় ঘুরেছি। কোথাও বলল, ‘যতদিন শুটিং করবে তার পয়সা তোমায় দিতে হবে’। কোথাও বলল, ‘তোমার উপর যত রিল ব্যবহৃত হবে সেই রিলটা তোমাকেই কিনে দিতে হবে’। এই সব শুনেটুনে ভাবছি কী করব। থিয়েটারে গেলাম। নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তর গ্রুপে। সেখানে কাপ ধোয়াত, ঘর পরিষ্কার করাত। যেদিন শো, তার আগের রাতে সারা কলকাতা ঘুরিয়ে নিজের পয়সায় পোস্টার মারাত। দেখলাম আমার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়।
তপন থিয়েটারে সত্য জেঠুর সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম বলে আমার সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁকেই একদিন বলে বসলাম কাজ পাচ্ছি না। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই এক কাজ কর, তপন থিয়েটারে ‘নাগপাশ’ নাটকের দীপকের সাবস্টিটিউট হয়ে যা।’ ৬ মাসের মধ্যে একদিনও সুযোগ এল না। সেই সময় তরুণ মজুমদার ‘পথভোলা’ ছবিটা তৈরি করবেন বলে ভাবছেন। পাঁচজন ছেলে দরকার। তিনজনের বাছাই হয়ে গিয়েছে। আরও দু’জন নতুন ছেলে নেবেন। সত্য জেঠু বললেন, আমার কাছে একটি নতুন ছেলে আছে। আপনি দেখতে পারেন।
…গেলাম পরের দিন। ভিতরে ঢুকলাম। দেখি তরুণ জেঠু বসে আছেন। দেবশ্রী কায় কাঁধ টিপে দিচ্ছেন। তাপল পাল সামনে বসে আছেন। সেই সময় আমার কী অবস্থা। ‘ভালবাসা ভালবাসা’ রিলিজ় করেছিল তখন। আমি নিজেই ৭ থেকে ৮ বার দেখেছিলাম। আমার হাঁটু কাঁপতে শুরু করে। আমাকে দেখে তরুণ জেঠু বললেন, ‘সব ভাল আছে। কিন্তু আমার একটু রাখটাফ চেহারা চাই’। তখন আমার খুব ভাল শারীরিক গঠন। বললেন, ‘চেহারা ভাল লেগেছে। মুখটা একদম চকোলেট হিরোর মতো। আপনি এক কাজ করুন, এক মাস চুল দাড়ি না কেটে আমার সঙ্গে দেখা করুন’।
এদিকে একমাস হতে চলল। আমার মাথা ভর্তি বড়-বড় চুল। মুখ ভর্তি বড়-বড় দাড়ি। আমি ভাবলাম গেছে। আমার আর হবে না।
একদিন এনটিওয়ানের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। পাশ দিয়ে একটা সাদা অ্যাম্বাস্যাডার গাড়ি এগিয়ে গিয়েই পিছিয়ে এল। গাড়ির ভিতর থেকে তরুণ জেঠু বললেন, ‘কী হল, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করছেন না কেন?’ আমি বললাম, ‘একমাস হয়নি তো। দু’-একদিন বাকি আছে।’ বললেন, ‘এক্ষুনি চলে আসুন।’
আমি গেলাম। সেদিনই সংলাপ পড়ালেন। সই করালেন। কাজটা আমি পেয়ে গেলাম। সেই আমার জার্নি শুরু হল। এটা ঠিক, ‘পথভোলা’র পর আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।”
আরও পড়ুন: Abhishek Chatterjee Demise: ‘হয়তো ওঁর মনের মধ্যে অনেক ক্ষোভ ছিল,’ কাঁদতে-কাঁদতে কেন বললেন ঋতুপর্ণা?