ঈপ্সা চ্যাটার্জী: মুম্বই তথা মহারাষ্ট্রের চলত শুধুই তাঁর রাজ। তাঁর এক কথায় বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। এমনই প্রতিপত্তি ছিল বালাসাহেব ঠাকরের। রাজনীতি থেকে ব্যক্তিগত জীবন, বর্ণময় চরিত্র ছিলেন বালাসাহেব ঠাকরে (Bala Saheb Thackeray)। কট্টর হিন্দুত্ববাদ ও মারাঠাদের উন্নয়নই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ধ্যান-ধর্ম ছিল। শুধু মহারাষ্ট্রই নয়, গোটা দেশের কাছে বালাসাহেব ঠাকরের ভাবমূর্তি ছিল অত্যন্ত গুরুগম্ভীর, যার অঙ্গুলিহেলনে রাজ্য পরিচালিত হত। বাবার মতোই হবে ছেলে, এটাই সকলে আশা করেন, কিন্তু রাজনীতিতে পা রাখার সময় থেকেই এই ভাবমূর্তি ভেঙে বেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন উদ্ধব ঠাকরে (Uddhav Thackeray)। বাল ঠাকরের অবর্তমানে বদলে গিয়েছে শিবসেনা (Shiv Sena)। কিন্তু শনিবারের একটা ছবি উসকে দিয়েছে নতুন জল্পনা। বাল ঠাকরে যেভাবে গাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে প্রচার চালাতেন, ঠিক সেইভাবেই দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে দেখা যায় উদ্ধব ঠাকরেকে। তবে কি সর্বস্ব হারিয়ে আবার বাবার জুতোতেই পা গলাতে চাইছেন উদ্ধব?
চেহারায় বাবার মতো হলেও, স্বভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত বালাসাহেব ঠাকরে ও তাঁর ছেলে উদ্ধব ঠাকরে। যেখানে বাল ঠাকরে বরাবর উগ্র, কট্টরপন্থী ভাবমূর্তি ধরে রেখেছিলেন, সেখানেই উদ্ধব ঠাকরে মীতভাষী, নরম সুরেই কথা বলতে অভ্যস্ত। সাধারণ মানুষের মধ্যে নিজেদের জায়গা তৈরি করার ক্ষেত্রেও বাবার উল্টো পথেই হেঁটেছিলেন উদ্ধব। যে কয়েক বছর দুইজনে একসঙ্গে রাজনীতিতে ছিলেন। এই দৃশ্যই পরিচিত ছিল। শিবসেনার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর দলের অন্দরেও পরিবর্তনের হাওয়া আনেন উদ্ধব। বাবার চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদ থেকে সরে কংগ্রেস ও এনসিপির সঙ্গে জোট বাঁধেন। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশেই শিবসেনার নাম ও প্রতীকের উপর থেকে অধিকার হারিয়েছেন ছেলে উদ্ধব ঠাকরে ও তাঁর সমর্থক শিবির।
যেই দলকে নিজের হাতে গড়েছিলেন বালাসাহেব ঠাকরে, ছেলে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে সেই দলই ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গিয়েছে। দলের অন্দরে বিরোধের জেরে উদ্ধব ঠাকরে ও একনাথ শিন্ডে-দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে শিবসেনা। মুখ্যমন্ত্রীর গদি থেকে সরকার, উদ্ধব ঠাকরে খুইয়েছেন সর্বস্ব। হারানোর তালিকায় নতুন সংযোজন দলের নাম ও প্রতীক। শিবসেনার নাম ও প্রতীক তীর ধনুকের উপরে কার অধিকার, এই নিয়েই টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল শিন্ডে ও ঠাকরে শিবিরের মধ্যে। শুক্রবারই নির্বাচন কমিশন জানায়, শিবসেনা নাম ও প্রতীকের উপরে অধিকার একনাথ শিন্ডের শিবিরের।
কমিশনের সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ উদ্ধব। শনিবারই তিনি জানান, কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। মাতোশ্রী, যা উদ্ধব ঠাকরের বাসভবন তথা দলীয় কার্যালয়, তার বাইরেই গাড়ির সানরুফ থেকে বেরিয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়েন তিনি, পাশে থাকার আর্জি জানান। কিন্তু এই ভঙ্গিমা তো উদ্ধবের নয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তারা এক নজরে উদ্ধব ঠাকরের ছবি দেখেই চিনতে পেরেছেন। এ তো বালা সাহেব ঠাকরের ভঙ্গি! তিনিও তো এভাবেই গাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতেন, হুংকার দিতেন মহারাষ্ট্রে বিপ্লব আনার। তবে কি নিজের ভাবমূর্তি বদলে বাবার জুতোতেই পা গলাতে চাইছেন উদ্ধব?
শনিবার বান্দ্রা পূর্বে যেভাবে গাড়ির সানরুফ থেকে বক্তব্য রাখেন উদ্ধব, ১৯৬০-র দশকে একইভাবে নিজের ফিয়াট গাড়ির বনেটে দাঁড়িয়ে বক্তব্য় রাখতেন বাল ঠাকরে। তাঁর গাড়িতে লাগানো থাকত একটি বিশেষ পিএ সিস্টেম, যাতে দূর-দূরান্ত অবধি তাঁর গলা পৌঁছে যায়। গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে এমনই একটি স্মরণীয় বক্তব্য় রেখেছিলেন বালাসাহেব, মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা নন যারা, তাদের মুম্বইয়ে ঢুকতে দেবেন না বলে হুশিয়ারি দিয়েছিলেন বাল ঠাকরে। ১৯৬৯ সালে মহিমে জিপের উপরে দাঁড়িয়ে বাল ঠাকরে যখন কর্নাটকের মারাঠীভাষী জেলাগুলিকে মহারাষ্ট্রের অন্তর্গত করার দাবি জানিয়েছিলেন, তার জেরে দাঙ্গা বাঁধে, ৫৯ জন মানুষের প্রাণ যায়। এই ঘটনার জেরেই যেমন প্রথমবার গ্রেফতার হয়েছিলেন বাল ঠাকরে, তেমনই জাতীয় রাজনীতিতেও নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন। শনিবার একই ভঙ্গিতে উদ্ধব ঠাকরেও গাড়ির সানরুফ থেকে বেরিয়ে যেভাবে বক্তব্য রাখেন, তাতে স্পষ্ট যে বাবার ভাবমূর্তিই এবার আপন করে নিতে চাইছেন উদ্ধব।
নাম-প্রতীক হারিয়ে শুধুমাত্র বাবার মতো গাড়ির উপর থেকে বক্তব্য রাখার পন্থা অবলম্বন করেছেন উদ্ধব। তবে সামনের পথ সহজ নয়। শুক্রবারই এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার উদ্ধব ঠাকরেকে বুঝিয়েছিলেন যে দলের নাম-প্রতীক এতটা গুরুত্ব বহন করে না। সাধারণ মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই দলের নতুন নাম ও প্রতীককে গ্রহণ করবে, ঠিক যেমন কংগ্রেসের প্রতীক বদলকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু শুধু বাবার অনুকরণে বক্তব্য রাখলেই তো হবে না, মহারাষ্ট্রে শিবসেনার হারানো জায়গা ফিরে পেতে অনেকটা লড়াই করতে হবে উদ্ববকে। তাঁর সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল শিবসেনার অবস্থান স্পষ্ট করা। বাল ঠাকরের গড়া শিবসেনা যেখানে কট্টর হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল, সেখানেই উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা সরে এসেছিল হিন্দুত্ববাদকে। দলের ভাঙনের সময় এই ইস্য়ুকেই হাতিয়ার করেছিলেন একনাথ শিন্ডেও। তিনি দাবি করেছিলেন, বালাসাহেবের দেখানো পথেই তাঁরা চলছেন। তাই তাঁরাই আসল শিবসেনা। উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে শিবসেনা হিন্দুত্ববাদ নিয়ে নিজেদের অবস্থান হারিয়েছে। এবার উদ্ধব ঠাকরে নিজের পুরনো ধাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন কি না এবং বালাসাহেবের মতোই শক্ত হাতে শিবসেনাকে নিয়ন্ত্রণ করে খোয়ানো জায়গা ফিরে পান কি না, তাই-ই এখন দেখার।