শুরু হয়েছে মহাকুম্ভ। প্রতি ১২ বছর অন্তর আসে কুম্ভস্নানের পূ্ণ্যতিথি। দেশের চার জায়গায় এই কুম্ভ মেলা হয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এগুলি হল প্রয়াগরাজ, বারাণসী, উজ্জয়ন ও নাসিক। এবার হচ্ছে বিরল মহাকুম্ভ। ১৪৪ বছরে প্রথমবার এই পূণ্য তিথি এসেছে। কুম্ভে পূণ্য স্নান করতে প্রয়াগরাজে ভিড় জমিয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশ-বিদেশ থেকে এসেছেন তারা। এই কুম্ভে আসেন নাগা সন্ন্যাসীরাও। তাদের জীবন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কীভাবে কেউ নাগা সন্ন্যাসী হন? কী কী ত্যাগ করতে হয় তাদের? মহাকুম্ভ হয়ে যাওয়ার পরই বা তারা যান কোথায়?
৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাদে যখন ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ ভারতে এসেছিলেন, তিনি বিভিন্ন ধর্মের সমাগম দেখেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল নাগা সাধুরা। অর্থাৎ বহু শতাব্দী ধরেই নাগা সন্ন্যাসীদের অস্তিত্ব ছিল। তাদের আরাধ্য দেবতা শিব। পাশাপাশি দিগম্বর জৈনকেও অনুসরণ করেন নাগা সন্ন্যাসীরা। আদিগুরু শঙ্করাচার্যই দেশজুড়ে আখড়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
গবেষকদের মতে, নাগা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে, যার অর্থ পাহাড়। অর্থাৎ যারা পাহাড়ে থাকতেন, তাদেরই পাহাড়ি বা নাগা বলা হত। ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করার পর যারা আর গার্হস্থ্য জীবনে ফিরতেন না, ধর্মপালন করতেন, তারাই নাগা সন্ন্যাসী হন। তবে সাধারণ সাধুদের থেকে নাগা সন্ন্যাসীরা অনেকটাই আলাদা।
কুম্ভমেলায় বিখ্যাত জুনা আখড়া। দূরদূরান্ত থেকে সাধু-সন্তরা আসেন। এই আখড়ার নাগা সন্ন্যাসী অর্জুন পুরী। তিনিই নাগা সন্ন্যাসীদের জীবন ও সন্ন্যাসী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বর্ণনা করেন। অর্জুন পুরী জানিয়েছেন, তিনি পাঁচ বছর বয়স থেকে নাগা সন্ন্যাসী। জ্ঞান হওয়ার পরই তিনি সাধুদের স্মরণাপন্ন হন। ভক্তি, ত্যাগ, সাধনায় জীবন উৎসর্গ করে দেন। সনাতন চিন্তাধারায় বিশ্বাসী তারা।
তবে সকলে নাগা সন্ন্যাসী হতে পারেন না। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়ার পর কেউ আর নাগা সন্ন্যাসী হতে পারেন না। যারা নাগা সন্ন্যাসী হন, তাদের ছোটবেলাতেই সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হয়। তপস্যা, ধ্যান, কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে তারা নাগা সন্ন্যাসী হন।
নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার যাত্রা শুরু হয় ব্রহ্মচর্য থেকে। এই প্রথম স্তরই অত্যন্ত কঠিন হয়, যা সকলে পালন করতে পারেন না। শৈশবেই আখড়ায় যোগ দিতে হয়। এরপর তাদের অনেক পরীক্ষা দিতে হয়, যেখানে তাদের মনের জোর, দৃঢ় প্রতীজ্ঞা ও একাত্ববোধ যাচাই করা হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ১২ বছর ব্রহ্মচর্যের জীবন কাটান তারা।
এরপরের ধাপে আসে পঞ্চ গুরু ও পিণ্ডদান। শিব, বিষ্ণু, শক্তি, সূর্য ও গণেশ- এই পাঁচ দেবতার আরাধনার পর সাধুরা নিজেদের পিণ্ডদান করেন। সাধারণত মৃত্যুর পরই পিণ্ডদান করা হয়। তবে সন্ন্যাসজীবনও যেহেতু নতুন একটি জীবন, তাই সন্ন্যাসী হওয়ার আগে তাদের পূর্ববর্তী জীবন সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হয়। সামাজিক, পারিবারিক বন্ধন ত্যাগ করে পিণ্ডদানের মাধ্যমে নবজন্ম হয় তাদের।
শেষ ধাপ হয় লিঙ্গ নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। এই সময়ে সন্ন্যাসীদের ২৪ ঘণ্টা উপবাস করতে হয়। গোটা একটা দিন তারা আখড়ার পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে থাকেন। এক চুলও নড়েন না। এই রীতির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধতা হয়। এই ধাপ উত্তীর্ণ হওয়ার পরই একজন নাগা সন্ন্যাসী হতে পারেন।
সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন নাগা সন্ন্যাসীরা। ভোর ৩টে, সাড়ে ৩টেয় উঠে তারা প্রথমে স্নান করেন। তারপর ধ্যান করতে বসেন। দেবতার নাম জপ করার পর যজ্ঞ শুরু করেন। নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ পড়েন। আশ্রম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও তাদেরই।
নাগা সন্ন্যাসীদের জীবনে রজোগুণ, তমোগুণের কোনও স্থান নেই। বহু মানুষই নাগা সন্ন্যাসীদের ভয় পান। তবে তাদের দাবি, তারা খুবই শান্ত। মন কোমল। সকলের উচিত একবার নাগা সন্ন্যাসীদের আখড়ায় এসে তাদের সঙ্গে কথা, আলাপচারিতা করা।
নাগা সন্ন্যাসীরা সাত্ত্বিক খাবার খান। ভাত, গম, রুটি, দুধ, দই, শাকসবজি, আলু এবং মিষ্টিই প্রধান খাদ্য তাদের। তবে দিনে মাত্র একবারই খাবার খান তারা। নাগা সন্ন্যাসীরা নিজে উপার্জন করেন না। তাদের ভিক্ষার উপরই জীবন নির্বাহ করতে হয়। সেক্ষেত্রেও নিয়ম রয়েছে। নাগা সন্ন্যাসীরা সাতটির বেশি বাড়ি থেকে ভিক্ষা চাইতে পারেন না। লোভ সংবরণের জন্যই এই নিয়ম।
নাগা সন্ন্যাসীদের অন্যতম পরিচয়ই হল তারা কোনও পোশাক পরেন না। কেন? নাগা সন্ন্যাসীরা শরীর থেকে মন শুদ্ধ রাখেন। সেই কারণে তারা পোশাক পরেন না। মোহ-মায়া ত্যাগেরই একটি অংশ পোশাক পরিত্য়াগ করা।
নাগা সন্ন্যাসীদের ঠান্ডা না লাগার অন্যতম কারণ হল তারা বিভূতি লাগান। মৃতদেহের ছাই বা বিভূতি, যা মন্ত্রপূত, তা নাগা সন্ন্যাসীদের শীত থেকে সুরক্ষা দেয়। তাছাড়া নাগা সন্ন্যাসীরা সংযমের জীবনযাপন করেন। তাই শরীরে শক্তি স্থির থাকে। শরীর ভিতর থেকে উষ্ণ হয়, যা প্রবল ঠান্ডাতেও সুরক্ষা দেয়।
বিনা পোশাক যেমন নাগা সন্ন্যাসীদের পরিচিতি, তেমনই তাদের জটাও অন্যতম পরিচিতি। নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার পর তাদের কাছে দুটি পথ থাকে, হয় তারা চুল কাটতে পারবেন না, জটা রাখতে হবে। নয়তো সম্পূর্ণ চুল কামিয়ে ফেলতে হবে। নাগা সন্ন্যাসীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থাকে তারা জটা রাখবেন নাকি ন্যাড়া হয়ে যাবেন।
কুম্ভ মেলা উপলক্ষে প্রয়াগরাজে এসেছেন নাগা সন্ন্যাসীরা। মেলা শেষ হয়ে গেলে তারা তীর্থে বেরিয়ে পড়েন। মূলত শীতল স্থানে থাকেন তারা। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের মতো পাহাড়ি নির্জন এলাকায় থাকেন। সেখানে পাহাড়ি গুহায় বাস করেন এবং সারা বছর সেখানে ধ্যান করেন।