In Depth on Indus Valley Civilization: ১ মিলিয়ন ডলার দেবেন স্ট্যালিন, শুধু পড়তে হবে এই হরফ, কোন অজানা ইতিহাস লুকিয়ে?
Indus Valley Civilization link with Tamil Nadu: রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন পাত্রে যে খোদাই পাওয়া গিয়েছে, যাকে গ্রাফিটি বলা হয়, তার সঙ্গে তামিলনাড়ুতে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন সামগ্রীতে পাওয়া হরফের মিল রয়েছে।
১ মিলিয়ন ডলারের অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন। করতে হবে শুধু একটা কাজ। আরও ভালভাবে বলতে গেলে, পড়তে হবে একটি লেখনী। তা পড়লেই রহস্য উদঘাটন হবে ৫০০০ বছর পুরনো সভ্যতার। আর সেই কাজে সফল হলেই মুখ্যমন্ত্রী দেবেন কড়কড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। কী সেই লেখনী? তামিলনাড়ুর কিরিডিতে উদ্ধার হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে মেলা বিভিন্ন হরফ।
ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে রয়েছে নানা অজানা কাহিনি। মানব সভ্যতার শুরুর সময় থেকে আধুনিক যুগ, প্রতিটি পাতায় লেখা নানা গল্প। তবে ইতিহাসের বইয়ে এমন কয়েকটি পাতাও রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে আজও দুর্বোধ্য় রয়ে গিয়েছে। এমনই এক পাতা হল সিন্ধু সভ্যতা। প্রাচীন এই সভ্যতাকে অন্যতম আধুনিক সভ্যতা বলেই মনে করা হয়। তাদের নগরায়নের পরিকল্পনা থেকে নিকাশি ব্যবস্থা, বাণিজ্যপথ আজকের আধুনিক আর্কিটেকচারকেও হার মানিয়ে দেয়। তবে সিন্ধু সভ্যতার এই আধুনিকতার পিছনের কারণ রহস্যই রয়ে গিয়েছে, কারণ সিন্ধু সভ্যতার বাসিন্দারা যে হরফে লিখতেন, তা পাঠোদ্ধার করা যায়নি। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে যে সিন্ধু সভ্যতাকে নিয়ে এত আলোচনা কেন? কারণ তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গেই মিল খুঁজে পেয়েছেন তাঁর রাজ্যে উদ্ধার হওয়া শিলালিপিতে।
স্ট্যালিনের ঘোষণা-
সম্প্রতিই ৫ জানুয়ারি এমকে স্ট্যালিন চেন্নাইয়ে আয়োজিত তিনদিনের আন্তর্জাতিক একটি কনভেনশনে ঘোষণা করেন যে সিন্ধু সভ্যতার লেখনী এখনও ধাঁধা রয়ে গিয়েছে। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর পাঠোদ্ধার করতে পারবে, তাকে ১ মিলিয়ন ডলারে পুরস্কিত করা হবে। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন হঠাৎ সিন্ধু সভ্যতাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছেন স্ট্যালিন? উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে তামিলনাড়ুতেই।
সিন্ধু সভ্যতার নগরী হরপ্পা থেকে ২০০০ কিমি দূরে অবস্থিত তামিলনাড়ুর কিরিডি। সেখানে খননের পর একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট মিলেছে, যেখানে অতীতের সভ্যতার নানা প্রমাণ মিলেছে। হাড়ি, পাত্র থেকে শুরু করে যাতায়াতের পথ মিলেছে। মনে করা হয়, ৬০০ খ্রীষ্টপূর্বে এই বসতি ছিল। শুধু কিরিডিই নয়, কডুকানাল, আড়িচানাল্লুরে এমন অনেক স্থাপত্যের খোজ মিলেছে। তবে যে বিষয়টি সকলের নজর কেড়েছে, তা হল এখানে উদ্ধার হওয়া পাত্র ও বিভিন্ন জিনিসে খোদাই করা চিহ্ন প্রতীক। যার অনেকটাই মিল রয়েছে সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত হরফের সঙ্গে। প্রত্নতাত্ত্বিক-গবেষকদের অনুমান, সম্ভবত তামিলনাড়ুর কিরিডির সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার যোগ ছিল। কিংবা এখানের নগরী তৈরিতে সিন্ধু সভ্যতার প্রভাব ছিল। আর সেখান থেকেই স্ট্যালিনের এই ঘোষণা।
তবে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি ও তথ্য প্রমাণ রয়েছে। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন পাত্রে যে খোদাই পাওয়া গিয়েছে, যাকে গ্রাফিটি বলা হয়, তার সঙ্গে তামিলনাড়ুতে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন হরফের মিল রয়েছে।
বিভিন্ন সভ্যতার ধাপ পেরিয়েই আজ মানবজাতি এই আধুনিক সভ্যতায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু অতীতে মানুষ কীভাবে বসবাস করত, তাদের সামাজিক কাঠামো, জীবনযাপন, পেশা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। সিন্ধু সভ্যতাও তেমনই এক রহস্য।
কী বলা হয়েছে গবেষণায়?
প্রত্ন গবেষক কে রাজন ও আর শিবানন্দনের গবেষণায় জানা গিয়েছে যে তামিলনাড়ুর ১৪০টি প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে মোট ১৫ হাজারেও বেশি পাত্র ও বিভিন্ন জিনিসের টুকরো পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে গ্রাফিটি রয়েছে। এইগুলির সঙ্গে মিল রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন সাইটে উদ্ধার হওয়া ৪ হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুর সঙ্গে মিল রয়েছে।
এগুলি নিয়ে গবেষণা করে মোট ৪২টি বেস সাইন, তার ৫৪৪টি ভ্যারিয়েন্ট ও ১৫২১টি কম্পোসিট ফর্ম চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ৪২টি বেস সাইনের সঙ্গে প্রায় ৬০ শতাংশ মিল রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে। দক্ষিণ ভারতের কিরিডিতে মেলা পাত্রের লিখন বা গ্রাফিটির সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার লেখনীর ৯০ শতাংশ মিল রয়েছে।
ইরাভাথম মহাদেবন ও আসকো পারপোলার মতো গবেষকরা দাবি করেছেন যে দ্রাবিড় ভাষার মিল রয়েছে। তাদের দাবি, হরপ্পা সভ্যতার ভাষা দ্রাবিড় লিপির প্রাথমিক রূপ। সেখান থেকেই তাদের অনুমান, সিন্ধু সভ্যতার স্ক্রিপ্ট বা লেখনী ইতিহাসে হারিয়ে যায়নি বরং তা পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন ভাষায় রূপ নিয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতা-
৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অস্তিত্ব ছিল সিন্ধু সভ্যতার। পাকিস্তান , উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান জুড়ে বিস্তৃত ছিল এই সভ্যতা। সিন্ধু নদীর পলিমাটি থেকে তৈরি সমভূমিতেই গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। নদী নির্ভর সভ্যতা ছিল এটি। হরপ্পা সভ্যতার প্রারম্ভ থেকেই এই অঞ্চলগুলি জনবহুল ছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে পরিচিত যে অঞ্চলটি, তা হল মেহেরগড়। যা পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে অবস্থিত।
বেলুচিস্তান থেকে পূর্বে পশ্চিম উত্তর প্রদেশ , উত্তরে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান থেকে দক্ষিণে গুজরাট রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিন্ধু সভ্যতার সর্বাধিক সংখ্যক সাইট রয়েছে পঞ্জাবে। এছাড়া গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, পাকিস্তানের সিন্ধ এবং বেলুচিস্তানেও একাধিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মিলেছে।
প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা বিখ্যাত ছিল তাদের নগর পরিকল্পনা, পোড়া ইটের বাড়িঘর, বিস্তৃত নিষ্কাশন বা নিকাশি ব্যবস্থা, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, বড় ভবন এবং হস্তশিল্প ও ধাতু সামগ্রীর জন্য। মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পায় সম্ভবত ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। পরে তা ৫০-৬০ লক্ষে পৌঁছয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দী থেকে এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে জল শুকিয়ে যায়, ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক রোগ, যার জেরে অবশেষে এই সভ্যতার অবসান ঘটে।
কী কী মিল রয়েছে?
৪০০০ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা তৈরি হয়েছিল। সড়ক, নালাপথ, বাণিজ্য পথ বানিয়েছিল তারা। সিন্ধু সভ্যতায় যে প্রতীক উদ্ধার হয়েছে, তা এখনও উদ্ধার করা যাচ্ছে না। সিন্ধু সভ্যতার যে প্রতীক বা হরফ ছিল, তা কোনও বর্ণমালা নয়, চার-পাঁচটা প্রতীক দিয়েই পুরোটা লেখা। মিশরের হাইরোগ্লিফিকের মতো নয় এই লেখনী। হাইরোগ্লিফিক পাঠোদ্ধার করার জন্য যেমন রোসেটা স্টোন রয়েছে, কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার হরফ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি এমন কোনও বিশ্লেষক পুঁথির অভাবে।
সিন্ধু সভ্যতার যে লেখনী বা প্রতীকগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি মূলত বাটির মতো পাত্রে ত্রিভূজ, মাছ খোদাই করে আঁকা ছিল। তামিলনাড়ুর কিরিডিতেও উদ্ধার হওয়া পাথরে একই রকম মাছ খোদাই করা মিলেছে। তামিল ভাষায় মীন বলতে তারাও বোঝায়। দ্রাবিড় সভ্যতায় মহাকাশ বিজ্ঞান ও গবেষণা হত, এমনটাই অনুমান করা হয়।
কিরিডির শহরের ব্লুপ্রিন্টে যে নিকাশি বা ড্রেনেজ সিস্টেমের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তা অনেকটা হরপ্পা সভ্যতার আধুনিক পরিকল্পনার অনুকরণ বলা চলে। এটা সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের স্থানান্তরিত হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। পাশাপাশি গবেষকরা জানিয়েছেন, যখন সিন্দু সভ্যতায় তাম্র যুগ চলছিল, তখন দক্ষিণ ভারতে লৌহ যুগ চলছিল। মাদুরাইয়ের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কিলাডিতে এমন বহু পাত্রের টুকরে মিলেছে, যাতে লাল-কালো তার, টিন-ব্রোঞ্জের মতো ধাতু ব্যবহার হয়েছিল। এখান থেকেই আন্দাজ এই দুই সভ্যতার মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান প্রদান হয়ে থাকতে পারে।
কেন এত আগ্রহ স্ট্যালিনের?
বরাবরই দ্রাবিড় সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে এসেছে। দ্রাবিড় সংস্কৃতি ও তামিল ভাষাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে কোনও কসুর রাখেননি। এমনকী রাজনীতিতেও টেনে এনেছেন ভাষা-সংস্কৃতিকে। সেখানেই হরপ্পা-মহেঞ্জোদারা বা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যদি দ্রাবিড় সভ্যতার যোগ পাওয়া যায়, তা রাজ্যের নাম উজ্জ্বল করতে পর্যটন থেকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করবেন স্ট্যালিন। পাশাপাশি তামিলনাড়ুর নাম স্থান পাবে সভ্যতার ইতিহাসের পাতায়। সেই কারণেই স্ট্যালিনের এই ১ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা।