‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’, সেই কবেই তো এ কথা বলে গিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু, স্রোতের পথে কখনও স্রোতের বিপরীতে চলতে চলতে বাংলা ভাষা কী তার নিজের রূপ খুঁজে পেল? নাকি কালের স্রোতে বিলীন হচ্ছে তার অন্তঃসার? ভাষা আন্দোলন থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবসের স্বীকৃতি, বাংলার ভাষার গরিমা, বাংলার ভাষার ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালির গর্বের অন্ত নেই। বাংলা এবার ‘ক্ল্যাসিকল’। পুজোর মুখেই আপামর বাঙালির জন্য বড় সুখবর শুনিয়েছে মোদী সরকার। ‘ধ্রুপদী’ তকমা দেওয়া হয়েছে বাংলা ভাষাকে। তাতেই উচ্ছ্বাসের বন্যা। বর্তমানে দেশে যে ১১ ভাষার দখলে রয়েছে এই বিশেষ স্বীকৃতি। কিন্তু, এতে ঠিক কতটা প্রভাব পড়বে ভাষার চালচিত্রে, ভাষা শৈলী থেকে ভাষার সামগ্রিক প্রসারে? সবটাই কী ইতিবাচক, নাকি কিছু নেতিবাচক ভূমিকাও রয়েছে? ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় বাংলা ভাষার ইতিহাস কিন্তু নেহাত নতুন নয়। সাক্ষী থেকে নানা বিবর্তনের। এবার ধ্রুপদী তকমা পাওয়ার পর সেই বিবর্তনের যাত্রা আরও তরাণ্বিত হবে? ভাষার গুরুত্ব কী আরও বাড়বে? ভাষাতাত্ত্বিকের মধ্যে কিন্তু এ নিয়ে নানা মতামত রয়েছে। কেউ বলছেন, ভাল পদক্ষেপ, কেউ আবার দেখছেন সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
ভাষা গবেষক অমিতাভ দাস বলছেন, “যে কোনও জ্যান্ত ভাষারই বিবর্তন হয়। যদি বিবর্তন না হয় তাহলে সেটা মৃত ভাষায় পরিণত হয়। এত বছর পরেও তো বাংলা ভাষা রয়ে গিয়েছে। তাই বাংলা ভাষা আগামীতেও থাকবে। তবে পৃথিবী অনেক বদলে গিয়েছে। ইকোনমি সেখানে শেষ কথা। তার ছাপ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পড়ছে। তবে প্রয়োজন অনুসারে অবশ্যই আমাদেরও বদলাতে হবে। নাহলে পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগটা তো থাকবে না।”
প্রসঙ্গত, সাহিত্য অ্যাকাডেমির নিয়ন্ত্রণাধীন Linguistics Experts Committee গত ২৫ জুলাইয়ের বৈঠকে বসেছিল। সেখানেই সামগ্রিক আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলা-সহ মোট পাঁচটি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাতেই চূড়ান্ত সিলমোহর দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। এদিকে এর আগে বাংলাকে ‘ক্ল্যাসিকল ল্যাঙ্গুয়েজ’ তকমা দেওয়ার জন্য একাধিকবার মোদী সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এবার তাতে সবুজ সংকেত মেলায় স্বভাবতই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অভিনন্দন জানিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। প্রসঙ্গত, বাংলার সরকার বাংলা ভাষার ধ্রুপদী তকমার সপক্ষে যে গবেষণা পত্র জমা দিয়েছিল কেন্দ্রের কাছে তা হয়েছিল ইন্সস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডি এন্ড রিসার্চের হাত ধরে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্বাতী গুহ। বাংলার ধ্রুপদী তকমায় উচ্ছ্বসিত তিনিও। তাঁর দাবি, বাংলার সমাগ্রিক প্রসারে এই নতুন স্বীকৃতি অনেক বড় ভূমিকা রাখতে চলেছে।
স্বাতী দেবী বলছেন, “বাঙালি হিসাবে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এটা তো অবশ্যই বড় পদক্ষেপ। এই শ্লাঘা তো আমাদের সকলের মধ্যেই কাজ করবে। বাংলা যদি বাংলার বাচ্চাদের না পড়ানো হয় তাহলে তারা তো তাঁর নিজের সংস্কৃতিটাই শিখবে না। তাই এই ধ্রুপদী তকমা পাওয়ার ফলে অভিভাবকেরাও গর্ববোধ করবেন। আরও বেশি করে বাচ্চাদের বাংলা শেখানোর পক্ষে আগ্রহী হবেন।” কিন্তু যেভাবে অন্যান্য ভাষার আগ্রাসন বাড়ছে, দাপট বাড়ছে, বাংলায় মুড়ি-মুড়কির মতো মিশছে হিন্দী-ইংরাজি তাতে কী বাংলার আসল কৌলিন্য আর থাকবে?
সাহিত্যিক সুবোধ সরকার কিন্তু বলছেন, “ভাষা নিয়ে এই দ্বন্দ্ব চিরকালীন। একটা জীবন্ত ভাষাক নিয়ম হচ্ছে সে সবরকম সমস্যার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবে। ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে এটা বিশ্বের পঞ্চম ভাষা। ২৮ কোটি মানুষ এই ভাষা জানে। এর একটা অন্য মর্যাদা অবশ্যই আছে। এখন যে ধ্রুপদী সম্মান পেয়েছে তা অত্যন্ত জরুরি ছিল। এটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখতে হবে।” এমনকী বাংলার প্রসারে রাজ্যে সরকারের একাধিক পদক্ষেপ বেশ খুশি তিনি। মমতার পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে যেভাবে গোটা কাজ করা হয়েছে, যেভাবে কেন্দ্রকে বোঝা গিয়েছে তা খুবই ইতিবাচক। বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াই তো ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে আগের অনেক মুখ্যমন্ত্রীদের থেকে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। তাঁর কাজ সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে বাংলা ভাষার প্রসারের ক্ষেত্রে আরও অনেক কাজ করার জায়গা রয়েছে। সেগুলি ভেবে দেখতে হবে।” যদিও অতীত নিয়ে কথা বলতে নারাজ শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। খানিক একই মত বাংলার অধ্যাপক শেখর সমাদ্দারেরও। পবিত্র সরকারের মতে, “এই তকমা বাংলা ভাষাকে এক পা এগিয়ে বা পিছিয়ে কিছুই দেয় না। বাংলা ভাষার অতীত গৌরব যা ছিল তাই আছে। আর ভবিষ্যত তো বাংলা ভাষাভাষি মানুষের হাতে, রাষ্ট্রের হাতে, রাজ্যের হাতে। রাষ্ট্রের উচিত বাংলা ভাষার প্রসারে অর্থ ব্যয় করা। বাংলা মাধ্যম স্কুলের আরও বিস্তার দরকার। ইংরাজি মাধ্যম স্কুলেও বাংলা ভাষার আরও প্রসার দরকার। অনেক স্কুলে নির্বোধের মতো বাংলা বলতে বারণ করা হয়। এটা আইন করে বন্ধ করা দরকার।”
অন্যদিকে শেখর সমাদ্দার বলছেন, “বাংলা ব্যবহারের প্রবণতা সমাজের বুকে কমে গেলে তো মুশকিল। আর সেটাই হচ্ছে এখন। স্বীকৃতি এসেছে, ঠিক আছে। কৌলিন্য বৃদ্ধি পেল। কিন্তু, অনেকদিন আগে তো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিও এসেছিল এই ভাষার হাত ধরে। কিন্তু, তারপর বাংলার চর্চা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তাই ভাষার চলমানতা সমাজের মধ্যে না থাকলে শুধু এই সার্টিফিকেট দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না।”
তবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন ইতিহাসবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। বলছেন, “এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম চেষ্টা করেছিলেন। এই স্বীকৃতি অনেক আগে পাওয়া দরকার ছিল। সংস্কৃত যা ধ্রুপদী ভাষা বলে পরিচিত তা অনেক পরে কিন্তু স্বীকৃতি পায়।” তবে তাঁর দাবি, আবহমানকালের হাত ধরে চলতে চলতে সব ভাষাই পায় নতুন চলশক্তি, নতুন পরিচিতি। বেড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে ভারে। স্বাতী, অমিতাভদের সুরেই তিনি আরও বলেন, “ভাষা তো চলতে থাকে। চলতে চলতে নানা ভাষা, শব্দ এসে যায় অন্য ভাষা থেকে। আরও নতুন নতুন ভাষা, শব্দ তৈরি হয়।”