কলকাতা: পর্ণশ্রীতে জোড়া খুনে (Parnashree Murder Case) গ্রেফতার করা হল দু’জনকে। মা ও ছেলেকে খুনের ঘটনায় নিহত মহিলার দুই ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সম্পর্কে তাঁরা নিহত সুস্মিতা মণ্ডলের মাসতুতো ভাই। রবিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে কলকাতা পুলিশের জয়েন্ট সিপি (ক্রাইম) মুরলীধর শর্মা জানান, অর্থের লোভে এই খুন বলেই প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। ধৃতদের নাম সঞ্জয় দাস (৪৪) ও সন্দীপ দাস (৩২)।
শনিবার রাতে সঞ্জয় ও সন্দীপকে প্রথমে আটক করে পুলিশ। কিন্তু কথায় অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এরপরই পুলিশের প্রশ্নের মুখে জেরবার দুই ভাই ধীরে ধীরে গোটা ঘটনায় আলোকপাত করতে বাধ্য হন। জানা গিয়েছে, সঞ্জয় দাস মোটা টাকার দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। তাঁদের মনে হয়েছিল, বোনের স্বামী যেহেতু ব্যাঙ্কের কর্মী, ঘরে প্রচুর টাকা থাকতে পারে। একই সঙ্গে বোনের সোনার গয়নার নেশা। ফলে ঘরে অনেক সোনার গয়নাও থাকতে পারে বলেই মনে করেছিলেন দুই ভাই। এরপরই সমস্ত পরিকল্পনা বলে তদন্তে জানতে পেরেছে পুলিশ।
গত ৬ সেপ্টেম্বর বেহালা (Behala Murder) পর্ণশ্রীর সেন পল্লির এক আবাসন থেকে মা ও ছেলের গলা কাটা দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, ঘটনার দিন দুপুরে সুস্মিতাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন সঞ্জয় ও সন্দীপ। বেলা ১২টা নাগাদ পর্ণশ্রীর ওই বাড়িতে ঢোকেন তাঁরা। বোনের সঙ্গে নানা গল্পও করেন। সেই সময় সুস্মিতার ছেলে তমোজিৎ অনলাইনে ক্লাস করছিল। ছেলের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন সুস্মিতা। এদিকে দাদাদের চা এবং কেক খেতে দেন তিনি। পুলিশ সূত্রে খবর, এই খাবার খাওয়ার সময়ই কথায় কথায় বোনকে অন্য মনস্ক করে তোলেন দুই ভাই। অভিযোগ, এর পরই সুস্মিতার গলায় ছুরির কোপ বসান একজন। সেই সময় তমোজিৎও ঘরে ঢুকে পড়েন। মায়ের ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে শিউরে ওঠে বছর তেরোর ওই নাবলক। অভিযোগ, এরপর তাঁকেও ওই একই ছুরি দিয়ে কোপানো হয়।
লালবাজারের গোয়েন্দাদের প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল, এই ঘটনায় পরিচিত কেউ যুক্ত। যাঁরা অবাধে মণ্ডল বাড়িতে ঢুকতে পারতেন। কারণ, পুলিশ সুস্মিতার স্বামী তপন মণ্ডলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, কেউ বাড়িতে এলে সুস্মিতা কি হোল দিয়ে দেখে তারপর দরজা খুলতেন। অর্থাৎ অপরিচিত কেউ হলে দরজা খোলার প্রশ্নই নেই। অন্যদিকে ঘরের ভিতর চায়ের কাপও আগেই দেখেছিল তদন্তকারীরা। অর্থাৎ খুনের ঘটনার আগে আততায়ী চা-খাবারও খেয়েছিল বলেই অনুমান করেছিল পুলিশ। ঘটনাস্থলে বেশ কিছু রক্তমাখা জামা কাপড়ও পেয়েছিল তারা। যা তথ্য প্রমাণ হাতে আসে, তার সবটাই অভিযোগের আঙুল পরিচিত কারও দিকেই তুলছিল। এরপরই পুলিশ পরিচিতদের একটি তালিকা তৈরি করে তদন্ত শুরু করে। একই সঙ্গে ‘টাওয়ার ডাম্পিং’ও করে পুলিশ। অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার সময় ও তার আগে এলাকায় কোন কোন নেটওয়ার্ক থেকে কত ফোন এসেছিল বা গিয়েছিল। এই সমস্ত থেকেই পুলিশের স্ক্যানারে উঠে আসে সুস্মিতার দুই ভাই সঞ্জয় ও সন্দীপের নাম।
এরপরই দু’জনকে আটক করে শনিবার লালবাজারে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করা হয়। এরপরই জেরায় কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেন তাঁরা। লালবাজার সূত্রে খবর, এই ঘটনার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছিলেন সঞ্জয়। কারণ, বাজারে তাঁর মোটা টাকা দেনা হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি ছেলেরও বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বেশ ভাল খরচ করেই বিয়ে দেন। এদিকে সঞ্জয় ধর্মতলার একটি শপিং মলে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দেখভালের কাজ করতেন। লকডাউনে সেখানে বেতন অনেকটা কমে যায়।
একদিকে ধার শোধ করতে না পারা, অন্যদিকে বেতন কমে যাওয়া এই দুই নিয়ে কিছুটা উদ্বেগে দিন কাটছিল তাঁর। প্রায় ২ থেকে আড়াই লক্ষ টাকা বাজারে দেনা হয়ে যায় সঞ্জয়ের। এদিকে সন্দীপও খুব বেশি আয় করতেন না। ফলে দুই ভাই মিলে এই পরিকল্পনা করেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
বোনের সোনার গয়না জমানোর একটা নেশা ছিল। প্রচুর গয়না কিনতেন সুস্মিতা। এরপরই দুই ভাই ঠিক করেন, কোনও ভাবে বোনকে সরিয়ে যদি এই গয়না হাতানো যায় তা হলে আর্থিক অনটন থেকে তাঁদের মুক্তি মিলতে পারে।
আরও পড়ুুন ‘আমার ছেলে চোর নয়, ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওরা মেরে ফেলল’, সন্তানের শোকে পাথর মা