উত্তরবঙ্গে বারংবার ঘুরে বেড়িয়েছি। শুধু বাইক কিংবা গাড়ি না, হেঁটেও অনেকবার করে ঘুরেছি। এই উত্তরবঙ্গের কোন গ্রামটা স্বর্গ মানে কাশ্মীরের মতো দেখায়, তা-ও খুঁজে বেড়িয়েছে। আমাদের সবারই ইচ্ছে থাকে এমন একটি গ্রামের সন্ধান খুঁজে বের করা যেটি স্বর্গের মতো সুন্দর এবং যেখানে আমরা বারবার হারিয়ে যেতে পারি। নানা গ্রামের ভূপ্রকৃতি এবং তার প্রাকৃতিক বৈচিত্র বিভিন্ন রকমের। এরই মধ্যে আমার চোখে দেখা সবচেয়ে সুন্দর এবং প্রাণবন্ত পরিবেশ খুঁজে পেয়েছি এই সিল্লেরিগাঁও-এ। আমরা সিকিমের পূর্ব দিকে মানে জুলুক নামক গ্রামে বারবার ঘুরে আসি, এরই মাঝে ফেলে রেখে যাই উত্তরবঙ্গের এই সুন্দর গ্রামটিকে। আজ মোটরসাইকেল ডায়েরির এই পর্বে আমি এই গ্রামটি যে কতটা সুন্দর এবং আশেপাশের ঘুরে বেড়ানোর স্পটগুলি কী-কী, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব যেখানে আপনি পাবেন সাইলেন্ট ভ্যালির মতো একটি স্বর্গীয় উপত্যকা (এখানে আপনি তাঁবু খাটাতেও পারেন)। এখান থেকে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ এবং চারপাশের প্রকৃতি দেখার সুযোগ। এছাড়াও অভয়ারণ্য, ঝর্ণা এবং অসাধারণ একটি লেক।
সিল্লেরিগাঁও, পেদং এবং পশ্চিমবঙ্গ-সিকিম সীমান্তে অবস্থিত লামপোখরি সংলগ্ন আরও বেশ কিছু গ্রামের সম্পর্কে জানতে এই মোটরসাইকেল প্রতিবেদনে রইল একাধিক তথ্য: সেখানে কীভাবে পৌঁছবেন, কোথায় থাকবেন, কোথায় টেন্ট খাটাবেন, কী করবেন এবং হিমালয়ের এই বিস্ময়কর গ্রামে বাইক নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা।
অফবিট উইকএন্ডের জন্য আমার ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে অবশ্য অধিকাংশ মানুষ যে ভাবে ঘোরেন, ঠিক সে ভাবে নয়। আপনাদের এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেগুলি বেশ অনন্য এবং সুন্দর। আমি সবসময় বিশ্বাস করি যে, পশ্চিমবঙ্গ এখনও অন্বেষণ করা যেতে পারে কারণ তা এমনই সব সুন্দর গন্তব্যে ভর্তি। এই স্থানগুলির সৌন্দর্য কেবল ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কালিম্পং থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এমনই একটি জায়গা। একাধিক ছোট-ছোট গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা এই অঞ্চল, যা সাধারণত আমাদের শহরের দৈনন্দিন জীবনে পাওয়া যায় না। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের চা বাগান তো আছেই।
চলুন… তবে আর দেরি না করে হাতে মাত্র চারটে দিন সময় নিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি এই গ্রামগুলির উদ্দেশ্যে। সঙ্গে একটি ছোট ব্যাকপ্যাক নিয়ে নিন। দু’সেট জামাপ্যান্ট। একটি গরম জামাপ্যান্টের সেট, যা রাতে লাগতে পারে (কীভাবে প্যাকিং করবেন তার বিস্তারিত বিবরণ আছে মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়-এ ১২ নম্বর পর্বে) কিছু শুকনো খাবার, কিছু এনার্জি বার, কিছু সাধারণ ওষুধ, আপনার অতিপ্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী। আর এক লিটারের জলের বোতল আর ক্যামেরা। যেহেতু আনুমানিক ৭০০ কিলোমিটারের রাস্তা (এক দিকের), তাই আরেকটি ছোট ব্যাগে ক্লাচ ও এক্সিলেটর কেবল, স্পার প্লাগ (এক সেট), পাংচার কিট আর একটি ছোট ডিজিটাল এয়ার পাম্প এবং এডজাস্টেবল রেঞ্জ ও স্প্যানার। রাতেই বাইকের সঙ্গে বাঞ্জি কড দিয়ে বেঁধে রাখুন এই সামগ্রী। এগুলো সাধারণত দরকার হয় না, কিন্তু ইমার্জেন্সির সময়ে নিজের কাছে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ভোরের শান্ত কলকাতাকে গুডবাই বলে NH2 ধরে সোজা চলে আসুন ডানকুনি, সিঙ্গুর হয়ে শক্তিগড়। এখানে আপনি সকালের খাবার খেয়ে সময় নষ্ট না করে চলে আসুন সাগরদিঘি-রঘুনাথগঞ্জ-ফারাক্কা-কালিয়াচক হয়ে মালদহ। এরপর রায়গঞ্জ, ডালখোলা, কিষানগঞ্জ হয়ে ইসলামপুর এবং সবশেষে শিলিগুড়ি। রাস্তা এখন বেশ ভাল; বেঙ্গল টু বেঙ্গল রোড না ধরে আপনি NH ধরে আসতে পারেন। আগের মতো সেই যানজট হয় না। শিলিগুড়ি পৌঁছতে আপনার প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে; তাই এখানকার কোনও হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়ুন কালিম্পংয়ের উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি থেকে যার দূরত্ব মোটামুটি ৭০ কিলোমিটার। এই রাস্তা অতিক্রম করতে সকালে আপনার আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যাওয়া। কালিম্পং যেহেতু পৌঁছেই গিয়েছেন, তাই সকলের খাবার খেয়ে আশপাশের বেশ কিছু জায়গা দেখতে ভুলবেন না। জায়গাগুলি হল: দুর্পিন ভিউ পয়েন্ট অথবা লাভার্স ভিউ পয়েন্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, দুর্পিন মনাস্ট্রি, আর্মি হসপিটাল দারা থেকে কিছু রামেটাই দারা (এই ভিউ পয়েন্ট সত্যিই খুবই সুন্দর, একটি পর্বতশ্রেণীর একেবারে শেষের একটি স্থান, যার খাঁড়াই ঢালের নিচে বয়ে যাচ্ছে রেলি নদী এবং অপর একটি পর্বতশ্রেণীর উৎপত্তি), ডেলো পার্ক, রামথুরা ভিউ পয়েন্ট, এরপর আপনি ডান দিক নিয়ে চলে আসুন ১৮ মিলে, তারপর আলগারাহ থেকে বাঁ দিক নিয়ে পেডং রেশি রোড ধরে কিছুটা যাওয়ার পর বাঁ দিক নিয়ে চলে আসুন পায়েঙ্গাওন ফরেস্ট, ফরেস্টের মধ্য দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর সিল্লেরিগাঁও।
এখানে আপনি নিজের মতো করে থাকুন। এখানে রিসর্ট এবং হোমস্টের মানুষ খুবই ভাল। আপনি চাইলে এখানে নিজে রান্না করেও খেতে পারেন। কাঠ এবং বাসনপত্র তারাই জোগাড় করে দেবে। এখানে আসার জন্য আগে থেকে বুকিংয়ের কোনও দরকার নেই। এখানে দু’দিন কাটানোর জন্য আদর্শ জায়গা। ফরেস্ট রেঞ্জ এনজয় করুন এবং পারলে সাইলেন্ট ভ্যালিতে একদিন রাত কাটান। অবশ্যই টেন্টটিং করে, আমার কাছে টেন্ট থাকার দরুণ ভাড়া করতে হয়নি।
সাইলেন্ট ভ্যালিতে রাত কাটিয়ে পরের দিন পেডং হয়ে চলে আসুন আরিতার ওয়াচ টাওয়ারে। এখান থেকে অসাধারণ কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ দেখা যায়। এরপর এরই পাশে অবস্থিত আরিতার লামপোখারি লেক, এখানকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র উপভোগ করতে আপনাকে একদিন কাটাতে হবে।
এরপর বাড়ি ফেরার পালা। বাড়ি ফেরার পথে রয়েছে এমন একটি লেকের সন্ধান, যেখানে খুব কম মানুষই যায়। নাম মুলখারকা লেক। এরপর ঋষি খোলা নদীর ঠিক পাশ দিয়ে পাডং হয়ে, কালিম্পং এবং সেবক ব্রিজ পার করে শিলিগুড়ি হয়ে কলকাতা।