চিকেন পক্স (Chicken Pox) বা জল বসন্ত হল এক ধরণের ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ। এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ। বাতাসের মাধ্যমে এই সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চিকেন পক্স হলে শরীরে যে গুটি গুটি দেখা যায়, তরল পদার্থ ভরা ওই ভ্যাসিকুলার র্যাশগুলি প্রচণ্ড চুলকায় এবং অনেক সময় জ্বরও আসে। চিকেন পক্স সেরে গেলেও এর দাগ দীর্ঘদিন পর্যন্ত থেকে যায়। তবে গ্রামবাংলায় এখনও চিকেন পক্স বা জলবসন্ত হলে দেবী শীতলার (Devi Shitala) পুজো দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।
নমামি শীতলাং দেবীং রাসভস্থাং দিগম্বরীং মার্জ্জনীকলসোপেতাং সূর্পালঙ্কৃতমস্তকাম্।।
এই সংস্কৃত শ্লোকের অর্থ হল, সেই দিগম্বরী শীতলা দেবীকে প্রণাম জানাই যিনি গাধার উপর বসে থাকেন, যিনি ঝাঁটা ও কলস শোভিতা, যাঁর মাথার অলংকার হল কুলো। হিন্দুর ‘শীতলা’, মুসলমানের ‘বুড়াবুবু’, বৌদ্ধের পর্ণ শর্বরীর সঙ্গে বিরাজিতা ‘হারিতী’, আদিবাসীদের ‘বসন্তবুড়ি’, উত্তরভারতের পার্বতী, দক্ষিণের শীতলাম্মা ও বাংলাসাহিত্যের শীতলামঙ্গলে বহু চর্চিতা লৌকিক দেবী।
ছোটবেলায় বাড়ির কাজের লোকেদের বলতে শুনেছি বসন্ত রোগকে বাংলা আবহমান কালে ‘মায়ের দয়া’র দাগ । এই ‘মা’ হলেন দেবী শীতলা। আমাদের দেশের এক প্রাচীন লৌকিক দেবী। কিন্তু বসন্ত রোগের দেবী শীতলার মাহাত্ম্য অনুসন্ধান করতে গেলে এমন কিছু অন্য উপদেবতার কথা উঠে আসে যারা বঙ্গসমাজে ব্রাত্য। স্কন্দপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শীতলাদেবীর উল্লেখ আছে। সেখানে তিনি গুটিবসন্তের ত্রাণকর্ত্রী। তিনি যজ্ঞাগ্নি সম্ভূতা। ব্রহ্মা কেবল তাঁকে নয়, তাঁর সহচর জ্বরাসুরকেও পুজো করার জন্য মানবজাতিকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
শবর জাতীয়রাই নাকি শীতলার পুজো চালু করেন। পরে সকল সম্প্রদায়ের কাছেই তিনি বসন্ত রোগের দেবী রূপে পূজিতা হন।বসন্তে পৃথিবী পৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে শুরু করে। ভক্তদের বিশ্বাস, এই সময় দেবী নিজে গঙ্গায় স্নান করে নিজে যেমন শীতল হন তেমনই পৃথিবীর মাটিকেও শীতল বা ঠাণ্ডা করেন। মনে করা হয়, তিনি শীতলার করুণা ভিক্ষা করলে দেবীর মন গলে, বিরাটরাজ্য রোগমুক্ত হয়।
পৌরাণিক কাহিনি
ব্রহ্মার কন্যা এবং কার্ত্তিকেয়ের স্ত্রী নাকি এই শীতলাকে। পুরাণ ছাড়াও এই দেবী আছেন সহজ সরল লোককথায়, যেমন শীতলামঙ্গল কাব্যে। আঠারো শতকের শেষের দিকে বাংলায় কবি মানিকরাম গাঙ্গুলি, দ্বিজ হরিদেব বা কবি জগন্নাথ, এমনকী আরও এক শতাব্দী আগে কবি বল্লভ এবং কৃষ্ণরাম দাস শীতলার বন্দনা করেছেন। মনসামঙ্গলের মত বাংলা সাহিত্যে শীতলামঙ্গল রচিত হয়। শীতলামঙ্গলেও সেই মনসামঙ্গলের মত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কে ঘোল খাইয়ে একজন প্রান্তিক, লোকদেবীর মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা পাওয়া। দেবতাদের অধিকার থাকবে কিন্তু মেয়েদের দেবী হবার অধিকার লাভের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে যুগে যুগে। শীতলা তাই বুঝি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমেছিলেন এলোচুলে, মারণরোগ ছড়িয়ে, অনুচর জ্বরাসুরকে নিয়ে। মানুষের দেহে জ্বর হয়ে প্রবেশ করে শিবভক্ত রাজা চন্দ্রকেতুর রাজ্যে ছড়িয়ে দিলেন সেই রোগ। নিজে রূপ নিলেন বৃদ্ধার। রাজ্যের সবাই মুখ ঘোরালো তার থেকে।আরো রেগে গেলেন তিনি। সমাজের আনাচেকানাচে আবাল-বৃদ্ধবনিতার মধ্যে ছড়াতে লাগলেন সেই রোগ, হাতে লাঠি, কাঁধে চৌষট্টি বসন্তের ঝুলি নিয়ে।
আরও পড়ুন: Phalguna Amavasya: ফাল্গুন অমাবস্যায় রয়েছে জোড়া যোগ! ইচ্ছাপূরণ করতে কোন কোন বিধি মানবেন, জানুন