
নীলের পুজো বা নীলষষ্ঠী হল সনাতন বাঙালীদের এক লোকোৎসব, যা মূলত নীল-নীলাবতী নামে এক বিবাহ উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক উৎসবের আগের দিন নীলপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সাধারণত, বাঙালী মহিলারা কন্যা বা পুত্রসন্তানের মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করে। নীল ষষ্ঠীর পরের দিন চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাত্ চৈত্র মাসের শেষ দিন। তারপরের দিন পালন করা হয় পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ।
সন্তানের সুখ, সৌভাগ্য ও দীর্ঘ জীবনের কামনা করে এই ব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে করে থাকেন বাঙালি ঘরের সব মায়েরা। বাংলার লোককথা মতে, নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা পুজোর সময়ে নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান। ভিক্ষা সংগ্রহ করেন বাড়ি বাড়ি। নীলের এই গানকে বলা হয় অষ্টক গান। ওইদিন সন্ধ্যেবেলায় সন্তানের মায়েরা সন্তানের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপূজা করে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন। সারাদিন কোনও রকম খাবার, পানীয় গ্রহণ করেন না তাঁরা। সারাদিন উপোস রেখে সন্ধের সময়য় মহাদেবের পুজো করে, তাঁর প্রসাদ খেয়ে তবে উপবাস ভঙ্গ করেন মায়েরা। এ বছর ১৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে নীল ষষ্ঠীর ব্রত। নীলের পুজো করে সন্তানের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন মায়েরা।
নিম বা বেল কাঠ থেকে নীলের মূর্তি তৈরি হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস পালন করা হয়। গভীর রাতে পালন করা হয় দেবতাদের হাজরা পূজা অর্থাত বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা। এছাড়া হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। পরদিন নীলপুজোর সময় নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়। তবে অন্ততপক্ষে সাত বাড়িতে নীলকে ঘোরানো হয়।
পৌরাণিক কাহিনি
বহু বছর আগে এক বামুন আর বামুনীর পাঁচ ছেলে আর দুই মেয়ে ছিল। এই দম্পতি পুজো-অর্চনার মধ্য দিয়েই দিন যাপন করতেন। কিন্তু এত পুজো, বারব্রত করেও তাঁদের সব ছেলেমেয়েগুলো একে একে মারা যায়। পর পর সন্তান হারিয়ে বামুনীর ঠাকুরদেবতার উপর থেকে বিশ্বাস চলে গেল। সন্তান শোকে সেই জায়গায় থাকতেও তারা অস্বীকার করে। বামুন-বামনী ঠিক করলেন সব ছেড়েছুড়ে তাঁরা মনের দুঃখে কাশীবাসী হবেন। দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করে অন্নপূর্ণার পুজো করে মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে থাকেন তারা দুজনে। এমন সময় দেবী ষষ্ঠী এক বুড়ি বামনীর বেশে বসে থাকার কারণ জানতে চান।
তখন বামুনী বলেন “আমার সব ছেলেমেয়েদের হারিয়েছি। এত পুজোআচ্চা সব বিফলে গেল আমাদের। সব অদৃষ্ট। ঠাকুর দেবতা বলে কিছ্ছু নেই।” ষষ্ঠীবুড়ি বললেন “বারব্রত নিষ্ফল হয় না মা, ধম্মকম্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকা চাই। তুমি ষষ্ঠীকে মানো? তাঁর পুজো করেছ কখনও? তিনি সন্তানদের পালন করেন। বামুনী বললে “আমি এতদিন ধরে সব ষষ্ঠী করে আসছি কিন্তু তবুও আমার ছেলেরা রইল না।
ষষ্ঠীবুড়ি বললেন, “তুমি নীলষষ্ঠীর পুজো করেছ কখনও? চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন উপোস করে শিবের পুজো করো। শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে জল খাবে তারপর। সন্তানদের মঙ্গলকামনা করবে”। বামুনী সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পুনরায় মাতৃত্ব লাভ করেন।