মৃত্যুর পাঁচ দশক পরও ‘জীবন্ত’ পান্নালালের গান! কেন মিটল না সাধ, পূরণ হল না আশা?
১৯৬৬ সাল। মার্চের শেষাশেষি। বসন্তের হিল্লোল তখনও মেলায়নি। এমন একটা দিনেই 'মরিবার হল তাঁর সাধ। মরমিয়া শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের ঝুলন্ত দেহ মিলল দক্ষিণ কলকাতার ভাড়াবাড়িতে। তার পর পেরিয়েছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময়। উল্কার মতো সুরের আকাশে আবির্ভাব পান্নালালের। কিন্তু আচমকা নিজের ইচ্ছায় জীবনের মঞ্চ থেকে কেন তাঁর প্রস্থান, সেই ধাঁধার সমাধান নেই। যেমন আজও নেই শ্যামাসঙ্গীত বা ভক্তিগীতিতে পান্নালালের ধারেকাছে পৌঁছতে পারা কোনও নাম! পান্নালাল ভট্টাচার্যর গলায় শ্যামাসঙ্গীতের দ্যুতি আজও অমলিন।
১৯৬৬ সাল। মার্চের শেষাশেষি। বসন্তের হিল্লোল তখনও মেলায়নি। এমন একটা দিনেই ‘মরিবার হল তাঁর সাধ। মরমিয়া শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের ঝুলন্ত দেহ মিলল দক্ষিণ কলকাতার ভাড়াবাড়িতে। তার পর পেরিয়েছে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময়। উল্কার মতো সুরের আকাশে আবির্ভাব পান্নালালের। কিন্তু আচমকা নিজের ইচ্ছায় জীবনের মঞ্চ থেকে কেন তাঁর প্রস্থান, সেই ধাঁধার সমাধান নেই। যেমন আজও নেই শ্যামাসঙ্গীত বা ভক্তিগীতিতে পান্নালালের ধারেকাছে পৌঁছতে পারা কোনও নাম! ৬৫-তে দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর সুরে পান্নালাল রেকর্ড করলেন ‘অপার সংসার নাহি পারাপার’। অল্প সময়ের ব্যবধানে রেকর্ড করেন, ‘ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে…।’ দুই গানেই ওপারের ডাক। আর ওই বছরই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, নিজেকে শেষ করে দিলেন তিনি।
‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলই ফুরায়ে যায় মা’ যাঁর গলায় জনপ্রিয়, সেই শিল্পীর এই গানের মধ্যেই হয় তো লুকিয়েছিল কোনও অতৃপ্তি বা আপ্রাপ্তি। বাইরের ছাঁদ দেখে তো তার তল পাওয়া ভার। খানিকটা হিসেব করেই শ্যামাসঙ্গীত গাইতে এসেছিলেন পান্নালাল। তাঁর আত্মহত্যাও বেশ ভেবেচিন্তে। চরম সিদ্ধান্তটা যে নিয়ে ফেলেছেন, তার সাক্ষী শেষের দিনগুলি। মৃত্যুর আগের দিন স্ত্রীকে নিজে মাছ রান্না করে খাইয়েছেন, খাইয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কেও। এর আগে ধনঞ্জয়ের দুই ছেলেকে কাঁকুলিয়ার বাড়িতে নিয়ে রাখেন। ওপারের হাতছানিতে সাড়া তারই পর।
আঁধার পথের একলা পথিকের সংসার-দরিয়া পারাপার কঠিন। পান্নালালও পারেননি, কূল অধরাই রয়ে গিয়েছে তাঁর! পান্নালালের গলায় ‘ওঠ না ফুটে মন’-এর ছোঁয়ায় থমকে যান চরম আস্তিকও। কিন্তু নিজের মন তো পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয়নি, সেই মনের চলন ছিল আঁকাবাকা পথে। তাই তাঁর গাওয়া অন্য গানেও রয়ে গিয়েছে সেই নির্জন-স্বাক্ষর!
পান্নালালের জন্ম ১৯৩০ সালে। হাওড়ার বালির বারেন্দ্রপাড়ায়। জীবনের শেষ কয়েক বছর ছিলেন কলকাতায়। কিন্তু বালিই পানু বা পেনোর মনোরথের ঠিকানা। মেজদাদা ধনঞ্জয়কে খানিক জড়িয়ে থাকলেও পান্নালাল নতুন করে জীবন্ত করে তুলছেন আঠারো শতকের রামপ্রসাদ সেনকে। শাক্ত পদাবলিতেও রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, দাশরথি রায়রা জুড়ে দিয়েছিলেন সহজিয়া বৈষ্ণব ধারা। পান্নালালের ছিল এই আখর।
মনের গোলকধাঁধায় পান্নালালের ঘুরপাক কিশোর বয়স থেকেই। বারেন্দ্রপাড়ার গঙ্গাঘাট লাগোয়া শ্মশানে গিয়ে বসে থাকত চঞ্চল দুরন্ত কিশোর। এই বয়েস থেকেই মা কালী পেয়ে বসে পান্নাকে। সবার মাঝেই একলা। কখনও রাতবিরেতেও গন্তব্য শ্মশান।পান্নালাল ভট্টাচার্যর দামাল শৈশব-কৈশোরকালেই ঝোড়ো হাওয়া গোটা বিশ্বের সমাজ-রাজনীতিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোলাবারুদ-ট্যাঙ্কের গর্জন তখন শোনা যাচ্ছে ইংরেজ শাসনের অধীন ভারত থেকে। বাংলাতেও আন্দোলনের তরঙ্গোচ্ছ্বাস। দেশভাগ, ছিন্নমূলের স্রোতে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতে ভাঙাগড়ার খেলা। গণনাট্য, আধুনিক গানে বাঙালির ভিন্ন ভিন্ন মন-মর্জি। তবে বারুদের আবহেও বাঙালির ভক্তিরসের সহজধারা শুকিয়ে যায়নি তখনও। ত্রিশের দশকের গোড়ায় নজরুল ইসলামের ভক্তিগান ‘জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী, চিন্ময়ী রূপে জাগো’ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কে মল্লিক। যিনি নিজেও ছিলেন নবীন পান্নালালের কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ। তবে ভক্তিগীতিতে সে সময় কে মল্লিক, ভবানী দাস, মৃণালকান্তি ঘোষের যোগ্য উত্তরসূরির খোঁজ চলছিল। পান্নালালের অন্তরের ভক্তিরসের জোয়ার শ্যামাসঙ্গীতে বইয়ে দেওয়ার রাস্তা বাতলে দিলেন মেজদা ধনঞ্জয়ই। গান শিখে গান করতে আসেননি পান্নালাল। প্রথম জীবনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। পরে যামিনীরঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। কিন্তু কোনও তালিম ধাতে সয়নি। সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত গায়ক তিনি।
সেই সময় বাংলা গানের কম্পোজিশনে বদল আসছিল। উন্নত হচ্ছিল রেকর্ডিং। মাসে মাসে বের হচ্ছিল নতুন নতুন রেকর্ড। সব মিলিয়ে নতুন নতুন গানের চাহিদা বাড়ছিল। সে চাহিদা মেটাতেই পান্নালালকে শ্যামাসঙ্গীত গাইতে বলেছিলেন ধনঞ্জয়। শাক্ত ও বৈষ্ণব ধারা মিলেমিশে একাকার বাংলার মাটি-জলে। কমলাকান্তর শুধু শাক্ত পদ নয়, বৈষ্ণব পদও আছে। প্রাচীন এই ধারা দাদা ধনঞ্জয়ের হাত ধরেই ফুটে উঠছিল পান্নালালের গলায়। হালিশহরের রামপ্রসাদ সেন ছিলেন গ্রামীণ কবি বা পদকর্তা। কিন্তু কমলাকান্ত ভট্টাচার্য রাজকবি। তাঁর পদে অলঙ্কার বা অঙ্গসৌষ্ঠব বেশি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারায় পান্নালাল জুড়ে দিয়েছেন তাঁর মরমিয়া আর্তি ও আবেগ। কমলাকান্তর গানও যা আমরা শুনি, তা আসলে পান্নালালেরই সংস্করণ।
‘চাই না মাগো রাজা হতে….’। পান্নালালের গলার হিরক-দ্যুতি এই গানেও। শ্যামাসঙ্গীতের মুকুটহীন রাজা-ই রয়ে গিয়েছেন তিনি। তবু নিজের জীবন বা গান নিয়ে কোনও দিন সন্তুষ্ট হতে পারেননি পান্নালাল। মায়ের আকুতি ক্রমশ বাড়ছিল তাঁর। একবার অনুষ্ঠান শেষে শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে করে ফিরছেন। হঠাতই বালি নামার একটু আগে পান্নালাল বলে উঠলেন, মাকে তুঁতে বেনারসী পরানো হয়েছে! কেউ বিশ্বাস করছেন না তাঁর কথা। শেষে নিজেই বললেন, নেমে চলো, দেখে আসি। হইহই করে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষের মতো শিল্পীরা। তবে অনালোচিতই রয়ে গিয়েছ তাঁর গাওয়া বাংলা আধুনিক গান। ১৯৫৬ সালে মমতা চট্টোপাধ্যায়ের কথা আর প্রবীর মজুমদারের সুরে ‘তীরে তীরে গুঞ্জন’, ১৯৬০ সালে শ্যামল ঘোষের কথা আর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘ও আমার কাজলপাখি’ও এখনও চমকে দিতে পারে শ্রোতাকে।
সুরের ভুবনে সফর শুরু কিশোরকালে। তারুণ্যের জগতে প্রবেশের আগেই খ্যাতির শিখরে পান্নালাল। কিন্তু সময়ের দাবি আর থাকবন্দি ইমেজ বোধহয় আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল তাঁকে। সাংস্কৃতিক পরিবেশ বদলে দিচ্ছিল বাংলা গানের ধারা। মূলস্রোতে চলে আসছিল ফিল্মি গান। মনের অন্দরের সঙ্গে বাইরেও তখন ঝড়। রেকর্ড কোম্পানির বাণিজ্য উপচে গিয়েছিল কিশোর পান্নাকে পেয়েই। এই পান্নালালকে ঘিরে ধরল একটা সাধকের ছবি। মাতৃস্নেহের যতই আকুতি থাক না কেন, সাধক নন, পেশাদার শিল্পীই হতে চেয়েছিলেন পান্নালাল। তাঁর বেপরোয়া, দামাল তারুণ্যের সঙ্গে সাধকের আলখাল্লা খাপ খেত না আদৌ। মৃত্যুর পর যেন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন পান্নালাল। বছরের পর বছর রেকর্ড বিক্রির টাকাই ছিল পরিবারের মূল রসদ। তবে প্রিয় মেজদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁদের সংসারের হাল ধরেছিলেন বলে যে প্রচার, তা নাকচ করে দিয়েছেন পান্নালালের মেয়ে শর্বরী।
মৃত্যুর পর যেন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন পান্নালাল। আজও কালীপুজো এলে বা শ্যামাসঙ্গীতের কথা উঠলে জিভের ডগায় চলে আসে পান্নালাল ভট্টাচার্যর নাম। কিন্তু বারোয়ারি মণ্ডপের বাইরে কি বাজেন তিনি?