মালদা: করোনাকালে ভয় ধরাচ্ছে ডেঙ্গু (Dengue)। শীত পড়লেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কথা, অন্তত এমনটাই দাবি করছেন চিকিতত্সকেরা। কিন্তু সে গুড়ে বালি! ডেঙ্গুর আক্রমণ কিন্তু কমছেই না। উপরন্তু তা বেড়েই চলেছে। বিশেষ বিপত্তি দেখা গিয়েছে মালদা জেলায়। সেখানে ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা।
কেন এভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ? কেনই বা সংক্রমণ কমে যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না? মালদা মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে খবর, রোজই ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে একাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অন্যদিকে, বেসরকারি সূত্রে খবর, জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তর সংখ্যা পাঁচশো ছাড়িয়ে গিয়েছে। শুধু মালদা মেডিক্যাল কলেজই নয়, গ্রামীণ হাসপাতাল, ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বেসরকারি হাসপাতালে একাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছেন। কেউ ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, কেউ বা ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে আসছেন। পরীক্ষার পর তাঁর ডেঙ্গু ধরা পড়ছে।
সূত্রের খবর, ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্ত দেখে পুরসভা এবং জেলা স্বাস্থ্য দফতরের যৌথ উদ্যোগে, একটি বিশেষ টিম তৈরির কথা ছিল। সেই বিশেষ প্রতিনিধিদলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা করার কথাও ছিল। কিন্তু স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এমন কোনও কিছুই প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দিনের পর দিন এলাকায় নর্দমা পরিষ্কার হয় না। যত্রতত্র পড়ে থাকে আবর্জনা। তাতে জলও জমে। গ্রামের দিকে অবস্থা আরও খারাপ। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গু নিয়ে কোনও সচেতনতা কাজ করছে না।
স্থানীয় এক এলাকাবাসীর কথায়, “এখনও অবধি কোনও সার্ভে করা হয়নি। বৃষ্টিতে এলাকায় জল জমেছিল। তারপর থেকে সেই জল পরিষ্কার করার জন্যও কোনও লোক আসেনি। ঘরে ঘরে লোকে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রশাসন কোনও উদ্য়োগ নিচ্ছে না। এর বিহিত না হলে আমরা থাকতে পারব না।” এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ, নালাগুলিতে নিকাশি ব্যবস্থা নেই। ফলে জলেই জন্মাচ্ছে ঘাতক ডেঙ্গুর জীবাণু।
এদিকে, মালদার চিকিত্সক মহলের দাবি, ডেঙ্গু পরীক্ষায় বিস্তর গরমিল রয়েছে। রেলের প্রাক্তন সিএমএস কর্তা ডি. সরকার বলেন, “পরীক্ষা নিয়ে একটা প্রহসন চলছে। একটা পরীক্ষা করতে দিলে কমপক্ষে আট থেকে ১০ দিন সময় লাগার কথা। সেই সময়টা কেউ দিতেও রাজি নয়, কেউ নিতেও রাজি নয়। কারণ এত বেশি ল্যাবরেটরি হয়ে গিয়েছে, যে সেই ল্যাবরেটরিগুলি আদৌ কী রিপোর্ট দিচ্ছে, কী দিচ্ছে না, কী করছে আসলে!”
অন্য আরেক চিকিত্সকের দাবি, ডেঙ্গু ও করোনা সাধারণ মানুষ গুলিয়ে ফেলেছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে কিছু বোঝার আগেই করোনার জন্য যা যা করণীয় সেসব বিধি পালন করছে। পরীক্ষা করাচ্ছেন না অনেকেই। ফলে ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কারণ, ডেঙ্গু ও করোনার চিকিত্সা পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রসঙ্গত, করোনাকাঁটায়, অলক্ষ্যে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে ডেঙ্গু (dengue)। হুঁশ ফিরছে না প্রশাসনের। রাজ্য জুড়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে এই একই ছবি। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, ২৭ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে সাড়ে ৬০০ জন আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গুতে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাই সত্যি হচ্ছে। ডেঙ্গুর দাপট বাড়ছে রাজ্যে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, ২৭ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বরের মধ্যে বাংলায় ডেঙ্গুর কবলে পড়েন ৬৫০ জন। গত বছর এই সময় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪১৯।
গত সপ্তাহ থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। চলতি সপ্তাহে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তাতে উত্তর ২৪ পরগনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ২৬৩ জন। কলকাতায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৯২ জন। হাওড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ১২২। নদিয়ায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩২ জন। দার্জিলিংয়ে এই সংখ্যাটা ২৬। এরপরই রয়েছে মালদহের স্থান। এখানে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও ৭৩। উত্তর দিনাজপুরে ১৬।
ডেঙ্গুর এই সংখ্যাবৃদ্ধি ক্রমেই চিন্তা বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনের। যদিও, খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ডেঙ্গু এখন হচ্ছে ঠিকই। তবে সেই সংখ্যাটা এখনও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়নি। সকলে সাবধানে নিয়ম মেনে থাকলেই ডেঙ্গু ছড়াবে না।” অভিযোগ উঠছে, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হতেই ডেঙ্গু নিয়ে বিশেষ কোনও পদক্ষেপ করছে না প্রশাসন। বাড়ি বাড়ি পরিদর্শনে যাচ্ছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরাও। জমা জল থেকেই ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এই বছর প্রথম ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা রাজ্যে ৯০০ ছাড়িয়েছে। রোজই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের।
ডেঙ্গুর উপসর্গ
যে কোনও রোগেরই উপসর্গ সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে রোগ মোকাবিলার প্রথম ধাপটাই আপনি জেনে গেলেন। উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবা পেতে সময় মতো রোগ নির্ণয় করা দরকার। চোখের ব্যথা, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা, বমি, হাড়ের ব্যথা, ফুসকুড়ি, পেশী ব্যথা, অস্বাভাবিক রক্তপাত, জয়েন্টে ব্যথা, ক্লান্তি বা অস্থিরতার মতো লক্ষণগুলি দেখা দিলে সতর্ক হোন। এগুলি ডেঙ্গুর উপসর্গ।
ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের হদিশ মিলেছে। এর মধ্যে বিপদজনক ডেন ২ ও ডেন ৩। এ রাজ্যে এই দুই সেরোটাইপেরই বাড় বাড়ন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, দেখা গিয়েছে ডেন ২ সব থেকে মারাত্মক। এর পিছনেই রয়েছে ডেন ৩। মাইক্রো বায়োলজিস্টরা বলছেন, ‘ডেন ২ ডেন ৩ মারাত্মক। অথচ এবারও শোনা যাচ্ছে এই দু’টো এ রাজ্যে ভালই পাওয়া যাচ্ছে। ডেন ৩ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।’ সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর ছয় থেকে সাতদিনের মধ্যে সেরে যায়। হেমারেজিক ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি। ডেন ২ বা ডেন ৩ ঘটাতে পারে ডেঙ্গু হেমারেজ। এর ফলে শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।
আরও পড়ুন: সপ্তাহের শুরুতে শীতের আমেজেও মিলতে পারে বৃষ্টি, কাজে বেরলে সঙ্গে রাখুন ছাতা…