‘মায়ের সাপোর্ট থেকেই…’, ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেই কোন সত্যি জেনে গিয়েছেন রাজনন্দিনী?
Rajnandini Paul: কোনও আন্দোলনেরই তো নির্দিষ্ট সময় থাকতে পারে না। পুজো পর্যন্ত হবে, তারপর বন্ধ হয়ে যাবে, আবার পুজোর পর শুরু হবে। আমাদের দেশে ২০০ বছর একটা আন্দোলন প্রতিবাদ চলেছিল। তখন কী পুজো হয়নি! উৎসব হয়নি! হয়েছে, পাশাপাশি প্রতিবাদও হয়েছে। সেভাবেই হবে। এই লড়াইটা থামবে না।
কাকভোরে ঘুম চোখে উঠেপড়া। বাড়ির প্রবীণরা তখন ব্যস্ত নানান কাজে। ধূপ জ্বালিয়ে তারই মাঝে দেওয়া হয়ে গেল পুজো। তখনই হয়তো রেডিওতে বেজে উঠল সেই চেনা সুর, ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে…’। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে না ঘুরতেই ভোরের আলো ফোঁটা। গোটা বাংলার পুজোর গন্ধ মেখে জেগে ওঠা। দূরদর্শনে তখন শুরু মহিষাসুরমর্দ্দিনী। বছর বছর পর্দায় মা দূর্গার গল্প বলা। কখনও ফিরত চেনা মুখ, কখনও আবার নতুন কেউ এই তালিকায় জায়গা করে নিত। তারপর আবারও এক বছরের অপেক্ষা। তবে এবার আর এক বছরের অপেক্ষা নয়। ২০২৪-এর মহালয়া মহিষাসুরমর্দ্দিনীর গল্প এনে দিল দর্শকদের হাতে মুঠোয়। কারণ ওটিটি (হইচই)-তে প্রথম মুক্তি পেল মহিষাসুরমর্দ্দিনী। এদিন বাঘাবাঘা তারকাদের সঙ্গে ভোর চারটে থেকে পর্দায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অভিনেত্রী রাজনন্দিনী পাল। মহিষাসুরমর্দ্দিনীর পর্দার ইতিহাসে কনিষ্ঠতম দূর্গা নাকি তিনিই। ছিলেন রাত জেগে। কেরিয়ারের অন্যতম বড় প্রজেক্ট, ঘুম হয়নি অভিনেত্রী। ভোর হতেই ফোনের পর ফোন, ভালবাসায় সকলে ভরিয়ে তুলছেন রাজনন্দিনীকে। TV9 বাংলার সঙ্গে শেয়ার করলেন সেই অভিজ্ঞতা।
সকলে কী বলছেন?
অনেকেই জানিয়েছেন খুব ভাল লেগেছে। গুরুজনেরা আশীর্বাদ করছেন, বলছেন আরও ভাল কাজ হোক। কাজের সঙ্গে তো যুক্ত রয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। তবে কিছু কাজ কেরিয়ারের মাইলস্টোন হয়ে ওঠে। আমার কাছে এটা তেমনই এক প্রজেক্ট। সকলের ভাললাগাটাই একজন অভিনেত্রীর কাছে বড় পাওয়া। আমি চেষ্টা করেছি। আনন্দটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই চরিত্র আমার কাছে স্বপ্নের মত। আমি এখনও ভাবতে পারছি না যে এই শোটা আমি লিড করেছি। এই চরিত্রটা পেতে অনেকে বহু বছর অপেক্ষা করেন।
সাধারণত মা দূর্গার রূপে টলিপাড়ার দাপুটে অভিনেত্রীদেরই দেখা যায়, সেখানে শুরুতেই তোমার হাতে এই প্রস্তাব…
একদমই ঠিক বলেছেন। এবারও অন্যান্য চ্যানেলে যাঁরা করছেন, আমি তাঁদের ভক্ত। তাঁদের ছবি দেখতে পছন্দ করি। তাঁদের কাজ আমার কাছে শিক্ষণীয়। ফলে আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ, যাঁরা এই চরিত্রটার জন্য আমায় ভেবেছেন। সুযোগ দিয়েছেন।
আপনি তো নাচের সঙ্গে যুক্ত, মঞ্চে কখনও এমন অভিনয় করেছেন?
আমি ক্লাসিক্যাল নাচ করি। মহিষাসুরমর্দ্দিনী না করলেও সবক্ষেত্রে একটা দেবী বন্দনা থাকে। যেটা দিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। নাচ তো আমার কাছে পুজো। তবে মহিষাসুরমর্দ্দিনী করার ইচ্ছে আমার বরাবরই ছিল। এত দ্রুত সেই সুযোগ হবে আমি সত্যি ভাবিনি। কিছু কিছু চরিত্র অর্জন করতে হয়। আমি সেটা পেয়েছি। আমার কাছে আশীর্বাদ। আমি সত্যি ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি কেউ আমায় এই সুযোগ দেবে। সাধারণত চ্যালেনে যাঁরা অভিনয় করেন, চ্যানেলের প্রযোজনায় তাঁরাই সুযোগ পান। আর সেক্ষেত্রে দূর্গা মানে কোনও বড় অভিনেত্রী। এটাই চেনা ছক।
মায়ের কেমন লেগেছে? (রাজনন্দিনী অভিনেত্রী নৃত্যশিল্পী ইন্দ্রাণী দত্তর কন্যা)
মা বরাবরই আমায় নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। অধিকাংশ সময় বলেছেন, কিছু দেখে সেটার অনুকরণ না করার কথা। সেখান থেকে ভালটা নিয়ে নিজের মতো করে যেন আমি আমারটা উপস্থাপনা করতে পারি। জীবনের সবক্ষেত্রেই তাই মায়ের বলা কথাটা মাথায় রাখার চেষ্টা করি। মায়ের কাছে আমার এই কাজটা যেমন আবেগ, তেমনই আবার তিনি এক্ষেত্রে আমার গুরুও বটে। মা যখন মহিষাসুরমর্দ্দিনী করেছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল একরকম। এখন সময় পাল্টেছে, সেট পাল্টেছে, উপস্থাপনা পাল্টেছে, তাই মা আমায় বিশেষ কিছু বলেনি এক্ষেত্রে। বলেছিলেন নিজের সেরাটা দিতে। আজ যখন মায়ের মুখে হাসি, চোখের কোলে জল দেখি, তখন মনে হয়, আমি সঠিক পথেই এগোচ্ছি। আমার মনে আছে, কাজের আগে মা বলেছিলেন, আমাদের নাচ আমাদেরই কোরিওগ্রাফ করতে হত। এত স্টাফ থাকত না সেটে। অধিকাংশ সময় নিজেদেরটা নিজেদের গুছিয়ে নিতে হয়। তখন দর্শকদের স্বাদ ছিল একরকম, এখন অন্যরকম। তাই সেই সময়ের কোনও টিপসই আর এখন খাটে না।
ছোট থেকে মহিষাসুরমর্দ্দিনী দেখা হত?
আমাদের বাড়িতে মহালয়া দেখার থেকে শোনার বেশি চল ছিল। খুব যে দেখেছি, এমনটা নয়। বরাবরই রেডিওর প্রতি ছিল বিশেষ টান। তাই মাও জানিয়েছিলেন, যে পুরোনো গুলো আর না দেখতে, যেটুকু দেখেছি, সেটুকুই মনে রেখে, নতুন প্রজন্মের নায়িকার থেকে দর্শক কী চাইতে পারে, সেটা মাথায় রেখে অভিনয়টা করা।
এরপর কী? ওটিটি-টেলিভিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করবেন, নাকি বড়পর্দার জন্যই প্রস্তুতি নেবেন?
টেলিভিশন করতে চাই না এমনটা নয়। তবে আমার ভীষণ লোভ। ভাল চরিত্রের লোভ। টাকা নয়, অভিনয়ের। আমার ভীষণ খিদে, ভাল ভাল চরিত্রের খিদে। দীর্ঘদিন একই চরিত্র হয়ে আমি বাঁচতে পারব না। তাই সিরিয়ালে যাওয়ার সাহস দেখাই না। আমি চাই কোনও একটা চরিত্র হয়ে উঠতে, সেটাকে নিজের করে গড়ে তুলতে, তারপর কাজ শেষে আবার অন্য চরিত্রের খোঁজ। টানা একটা বছর একটা চরিত্র হয়ে বাঁচলে আমার মনে হবে, আরও কত চরিত্র আমার হয়ে ওঠা হল না। এটা আমার সৌভাগ্য, আমি যখন স্কুলে পড়ে বিভিন্ন চ্যানেল থেকে আমায় কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত সকলে বলে রেখেছেন, যদি কখনও মত বদল করি, আমি যেন তাঁদের জানাই। এটা অনেক বড় পাওয়া। তবে আমি বড়পর্দাতেই থাকতে চাই। বড় পর্দাতেই নিজেকে দেখতে চাই। তাতে অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হোক। আমি নিজেকে তৈরি করে যাব। সিরিয়ালে কাজ করার কিন্তু অনেক মজা। কাজটা দ্রুত শেখা যায়, সংলাপ মুখস্থ করার অভ্যাস তৈরি হয়। খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। সেই সূত্রে অনেক শো আছে। কিন্তু আমি এই মুহূর্তে প্রস্তুত নই। তারপর জানি না কপালে কী আছে, ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, এটা আমার স্বপ্ন, এটুকু বলতে পারি।
জনপ্রিয়তা বিষয়টা তাহলে ভাবাচ্ছে না?
অনেকেই হয়তো বলবেন ২০২১ সাল থেকে আমি কাজ করছি, কী এমন কাজ করেছি। বিষয়টা এটা নয়। আমি চাই না সব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আমি বেছে বেছে কাজ করতেই পছন্দ করি। মা কিংবা ইন্ডাস্ট্রির গুরুজনেরা সব সময় আমায় এই উপদেশই দিয়ে এসেছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও সমস্যায় পড়লে বা মনে কোনও প্রশ্ন থাকলে আমি সবার আগে বুম্বা আঙ্কেলকে (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) একটা ফোন করি, কিংবা ঋতুপর্ণা আন্টিকে (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) একটা ফোন করি। জানতে চাই আমি কী করব? তাঁরা আমায় এইটুকু বিশ্বাস করিয়েছেন, যে আমি যা করছি, সঠিক। সঠিক পথে এগোচ্ছি। তাই খুব একটা ভাবি না।
উৎসবে ফেরা হচ্ছে?
আমি কাজেই রয়েছি। কাজের মধ্যেই থাকতে চাই। এই পুজোতে অন্তত আমি কাউকে সেভাবে বিনোদন দিতে চাই না। কারণ আমি চাই না এত আলো, আনন্দ উৎসবে বিপ্লব চাপা পড়ে যাক। কোনও আন্দোলনেরই তো নির্দিষ্ট সময় থাকতে পারে না। পুজো পর্যন্ত হবে, তারপর বন্ধ হয়ে যাবে, আবার পুজোর পর শুরু হবে। আমাদের দেশে ২০০ বছর একটা আন্দোলন প্রতিবাদ চলেছিল। তখন কী পুজো হয়নি! উৎসব হয়নি! হয়েছে, পাশাপাশি প্রতিবাদও হয়েছে। সেভাবেই হবে। এই লড়াইটা থামবে না।
মহিষাসুরমর্দ্দিনীর চরিত্র শক্তি, অন্যায়ের প্রতিবাদের মুখই তো দেবী দুর্গা। নারীশক্তির প্রতীক। চরিত্রটা করার সময় এগুলো অনুভব করেননি? আপনি তো হেঁটেছেন মিছিলে?
আমি বিশ্বাস করি প্রতিটা নারীর মধ্যেই দেবী রয়েছেন। প্রতিটা নারীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আছে। শক্তি আছে। আমি মনে করি মেয়েদের শরীরে বল কম হলে পারে, তবে মনের জোর দ্বিগুন। আমি, আপনি আমরা সকলেই নিজের শেষে চিৎকার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাই। কখনও কেউ সেই সাহসটা দেখান, কেউ সমাজের ভয়ে চুপ করে যান। তবে শক্তি সকলের মধ্যে আছে। আগে নিজেকে নিজে আবিষ্কার করতে হবে। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
আপনার সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন? নাকি মা ইন্ডাস্ট্রিতে থাকায় এক বড় ঢালের কাজ করেছে আপনার ক্ষেত্রে!
আমার মা আছেন ইন্ডাস্ট্রিতে বলে আমি নিশ্চিন্ত, এমনটা আমি দাবি করব না। আবার খুব বড় কিছু ঘটেছে আমার সঙ্গে সেটাও বলব না। তবে আমার সঙ্গে যে সবাই খুব ভাল ব্যবহার করেছেন, ভুল-ভাল প্রস্তাবের ইঙ্গিত যে দেননি, এই দাবি আমি করব না। সেই মুহূর্তেই আমি প্রতিবাদ করেছি। যেখানে যখন জানানোর জানিয়েছি। প্রয়োজনে মাকে বলেছি। আমার ব্যক্তিজীবনেও, যখন কেউ সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা করে, আমি তাকে আমার তালিকা থেকেই বাদ দিয়ে দিই। এই কারণেই আমার ব্লকলিস্ট ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে চলেছে। অনেকেই হয়তো কথা গুলো শুনলে বলবেন– ওমা এতে এমন আর কী! আমি একটা মেয়ে, আমি জানি কোনটাতে আমার কী? ইঙ্গিত বোঝার ক্ষমতা আমার আছে। এমন অনেক চতুর ব্যক্তি আছেন, যাঁরা ভদ্র ভাষায় বুঝিয়ে দিতে পারেন, আমার ভাষা ভদ্র নয়। সত্যি বলছি আমার এমন কাজের প্রয়োজন নেই, যেটা পেতে আমায় অস্বস্তিতে পড়তে হবে। তিনি হয়তো খুব বড় শিল্পী, আমার চোখে বড় মানুষ নন। কারণ তিনি আমায় সেই স্বস্তি, ভরসা, পরিবেশটা দিতে পারছেন না। তাই আমি ফিরেও তাকাই না। ভাবি না এই প্রযোজনা হাউসটা আমার ভবিষ্যতে ডাকবে কি না…। আর এই জোরটাই আসে আমার মায়ের সাপোর্ট থেকে।