Explained: দশ মিনিটের ‘লড়াই’, জানুন কতটা বিপদে রয়েছেন ডেলিভারি বয়রা
10 Minutes Delivery: বর্তমানে দেশে ৯৭ শতাংশ গিগ কর্মীদের বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ টাকার নীচে। এই টাকার পরিমাণ অনেকের কাছেই বিরাট মনে হতেই পারে, এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। এই গিগ কর্মীরা মূলত কাজ করে থাকেন শহরাঞ্চলে। এই টাকার মধ্য়ে তাঁদের পেট্রোল খরচ, বাইক মেরামতির খরচ, সারাদিনের খাওয়ার খরচের মতো একাধিক খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে।

রেটিংটা একটু দিয়ে দেবেন? গোটা দিনে একবারের জন্যও হলেও এই বাক্য প্রায় প্রত্যেকের দিকে ধেয়ে আসে নিশ্চয়ই। খাবার অর্ডার হোক বা অন্য কোনও সামগ্রী হাতের মুঠোফোনে জাস্ট একটা ক্লিক। লাল বা কমলা পোশাক পরা দু’চাকার সওয়ারিরা চলে আসবেন আপনার কাছে। এটাই আজকের যন্ত্রসম জীবনযাপনে ‘গিগ’ কর্মীদের ছবি। অন্যান্য ই-কমার্স পণ্যের ডেলিভারির সঙ্গে এই কর্মীদের ফারাক রয়েছে। তাঁদের প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় মাত্র ১০ মিনিট। যা তাঁদের প্রতি মুহুর্তে টেনে আনে পাহাড়ের অপরিচিত কিনারায়। আচ্ছা, এই ১০ মিনিটের ডেলিভারি কি এবার বন্ধের সময় এসেছে? সংসদে এই নিয়ে কিন্তু আলোচনা চলছে।
যন্ত্রসম জীবন
বর্তমানে যে সকল সংস্থা এই গিগ কর্মীদের নিয়োগ করেন, তাঁরা প্রত্যেকেই কাজের প্রথম দিনে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেন। ডেলিভারি কর্মীদের বলে দেওয়া হয়, তাঁরা এই সংস্থার অধীনস্থ কোনও শ্রমিক নন, বরং ফ্রিল্যান্সার— তাঁদের পরিভাষায় ‘ডেলিভারি পার্টনার’। কাজের ভিত্তিতে মিলবে টাকা। সময় নয়, যখন কাজ আসবে, সেই টুকুর ভিত্তিতে দেওয়া হবে মজুরি। যত বেশি সময় অনলাইন থাকা যাবে, তত বেশি সময় আয়। শুনতে স্বাধীন লাগলেও, এটা মোটেই স্বাধীনতার রূপ নয়।
টিমলিজ ডিজিটালের একটি পরিসংখ্য়ান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৯৭ শতাংশ গিগ কর্মীদের বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ টাকার নীচে। এই টাকার পরিমাণ অনেকের কাছেই বিরাট মনে হতেই পারে, এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। এই গিগ কর্মীরা মূলত কাজ করে থাকেন শহরাঞ্চলে। এই টাকার মধ্য়ে তাঁদের পেট্রোল খরচ, বাইক মেরামতির খরচ, সারাদিনের খাওয়ার খরচের মতো একাধিক খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে। শুধু তা-ই নয়, সংস্থা প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ৭৭ শতাংশ গিগ কর্মীদের আয় বছরে আড়াই লক্ষ টাকার নীচে। অর্থাৎ মাসে ২০ হাজার টাকাও নয়। আর মাত্র ২০ শতাংশের আয় আড়াই লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষের মধ্যে।
নেই কাজের কোনও সময়সীমা, নেই কোনও নিয়ম-নীতি। ভোর থেকে রাত ছুটে চলেছে তাঁরা। যার যত অর্থের প্রয়োজন, তিনি তত বেশি সময় ধরে সংশ্লিষ্ট সংস্থার অ্য়াপে অনলাইন থাকছেন। সংস্থার সরাসরি কর্মী না হওয়ায় নেই বিমা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির মতো ন্যূনতম অধিকার। সংস্থার কাছে এই ডেলিভারি পার্টনারদের কোনও স্বতন্ত্র পরিচয় পর্যন্ত নেই। মানুষ থেকে তাঁরা হয়ে উঠেছেন যান্ত্রিক কোড। মানবচরিত্র, মানবসম্পর্ক, ছুটির আর্তি, সব কিছুর উর্ধ্বে যেন তাঁরা। কেউ কেউ এই পরিস্থিতিকে কার্যত তুলনা করছেন দাসত্বব্যবস্থার সঙ্গেও। সম্প্রতি সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেও এই মর্মে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাজ্যসভা সাংসদ রাঘব চাড্ডা।
এদিন তিনি বলেন, ‘এই মানুষেরা রোবট নয়, সমাজ এদের গিগ কর্মী হিসাবে দেখে। কিন্তু আমি এদের দেশের অর্থনীতির অদৃশ্য চাকা বলি। যাদের দৌলতে আমরা চলছি। তারাও কারোর বাবা, কারোর স্বামী, ভাই বা ছেলে। সংসদের উচিত তাদের কথা ভাবা। তাই ১০ মিনিট ডেলিভারির এই অমানবিকতা বন্ধ করা উচিত।’
শরীর একটা কিন্তু এরা লড়ছে তিনটি স্তম্ভের সঙ্গে। একটি গ্রাহক, অন্যটি প্রেরক এবং তৃতীয় স্তম্ভ রাস্তার আইনরক্ষক। দশ মিনিটের ডেলিভারির ‘প্রতিশ্রুতি’ পূর্ণ করতে জীবন বাজি রাখছেন গিগ কর্মীরা। চলছে এক অসম লড়াই। কখনও সিগন্যাল ব্রেকিং, কখনও ওভার স্পিডিং, কখনও বা তাঁদের হাতছানি দিচ্ছে মৃত্যু।
বেকারত্বই কি কারণ?
নীতি আয়োগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে এই গিগ কর্মীর সংখ্যা এক কোটির সামান্য বেশি। যা আগামী পাঁচ বছরের মধ্য়ে বেড়ে আড়াই কোটি পর্যন্ত চলে যেতে পারে বলেই মনে করছে কেন্দ্র। কিন্তু যে পেশায় এত সমস্যা, এত অনিশ্চয়তা, সেখানেই এত কেন ভিড়? শুধুই বেকারত্ব, অল্প শিক্ষিত যুবসমাজ এর কি মূল কারণ? নাকি ভেঙে পড়া সমাজব্যবস্থাও কলকাঠি নাড়ছে এই বৃদ্ধির পিছনে।
একটা বিরাট বড় যুবসমাজ বেকার, এতে কোনও সন্দেহ নেই। একটা অংশ স্বেচ্ছায়, অর্থাৎ সরকারি চাকরির পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার জন্য নিজেদের কর্মহীন রেখেছেন। একটা অংশ অনিচ্ছায়। করোনার সময় অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল ৮ শতাংশ। যা ২০২৪ অর্থবর্ষে নেমে আসে ৩.২ শতাংশে। কিন্তু চলতি বছরের শ্রম মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুন মাসেই ভারতের বেকারত্বের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ। মে মাসে ছিল ৫.১ শতাংশ। এই পরিসংখ্য়ানে শুধুমাত্র তাঁদের রাখা হয়েছে, যারা চাকরি তো খুঁজছেন কিন্তু পাচ্ছেন না। একাংশ মনে করছেন, এই বেকারত্ব কোথাও গিয়ে গিগ কর্মীর মতো কাজে যোগদানের অণুঘটক হিসাবে কাজ করছে।
শুধু তা-ই নয়, সাম্প্রতিককালে দেশের ছোট-বড় সংস্থায় চাকরি যাওয়ার হিড়িকও কোথাও গিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলেই মত একাংশের। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছর বিশ্বজুড়ে এখনও পর্যন্ত চাকরি গিয়েছে ১২ লক্ষ কর্মীর। মেটা, অ্যামাজন, টিসিএস-এর মতো বড় বড় সংস্থা থেকে ছাঁটাই হয়েছে ১ লক্ষের অধিক কর্মচারীর। এমনটা নয় যে এত বড় বড় সংস্থা থেকে চাকরি হারানো কর্মীরা গিগ ওয়ার্কার হয়ে যাচ্ছেন। বরং যেখানে এত বড় বড় সংস্থা থেকে একের পর এক কর্মীদের উৎখাত করে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আঁধারে থাকা ছোট সংস্থাগুলির কী হাল? ডেলিভারির মতো পেশা সেই সকল চাকরিহারানো, বেকার যুবদের কাজ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোন শর্তে? কোন পরিস্থিতিতে? সেটাও দেখার বিষয়। কোথাও গিয়ে যেন এই সকল কর্মীদেরই রেখে দেওয়া হচ্ছে আলো-আঁধারির মাঝে।
অবশ্য, এই গিগ ওয়ার্কারদের এমন পরিণতি, গিগ ইকোনমির বাড়-বাড়ন্ত এবং দিনশেষে স্টার্ট-আপ দুনিয়ায় ভারতের হোঁচট খাওয়ার নেপথ্যে সংস্থাগুলির দিকেই দায় ঠেলছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য়মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেন, ‘ভারতের স্টার্ট-আপ কোম্পানিগুলি এসব কী করছে? ফুড ডেলিভারি সংস্থা তৈরি করছে, বেকার যুবদের সস্তার শ্রমিকে পরিণত করছে, ধনীদের দুয়ারে পণ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। অন্যদিকে চিন, তাঁরা কাজ করছে বৈদ্যুতিক, ব্যাটারি চালিত সরঞ্জাম নিয়ে।’
দেশের গিগ কর্মীদের পরিণতি কার্যত ভয়াবহ। যা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। সংসদে দাঁড়িয়ে দশ মিনিটের ডেলিভারি বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছে আপ সাংসদ। এই গিগ কর্মীদের স্বার্থে ইতিমধ্য়ে নানা পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। সামাজিক সুরক্ষা খাতিরে তাঁদের দেওয়া হয়েছে পেনশনে বিনিয়োগের অধিকারের মতো একাধিক সুবিধা। তবে এটা কি যথেষ্ট? তাঁদের জীবনের নিশ্চয়তার কী প্রয়োজন নেই?
