বিশ্লেষণ: ডায়েরির পাতার ভাঁজে আডবাণী, যশবন্তদের নাম, কী সেই ‘হাওয়ালা-জৈন’ মামলা?
Explained: একসময় বিত্ত ও ক্ষমতার অধিপতি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন শিল্পপতি সুরেন্দ্র জৈন। আর তাঁর ডায়েরি থেকেই উঠে এসেছিল একের পর এক প্রভাশালীর নাম।
কলকাতা: রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের সংঘাত নতুন নয়। জগদীপ ধনখড় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হওয়ার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সংঘাত বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। সাম্প্রতিককালে, সেই প্রবণতা বেড়েছে আরও। কিন্তু সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে গিয়ে ৩০ বছর আগের এক মামলার কথা তুলে আনলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি দাবি করেছেন ‘হাওয়ালা মামলা’ বা ‘জৈন ডায়েরি মামলা’য় নাম রয়েছে রাজ্যপালের। রাজ্যপালকে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত বলেও দাবি করেছেন তিনি। যে হাই প্রোফাইল মামলায় একসময় দেশের তাবড় রাজনীতিকদের নাম সামনে এসেছিল সেখানে কী সত্যিই ছিল ধনখড়ের নাম? রাজ্যপাল নিজে অবশ্য সেই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু কী এই হাওয়ালা মামলা? কী ছিল সেই গোপন ডায়েরিতে? ফিরে যেতে হবে বছর ৩০ আগে।
হিজবুল জঙ্গির জবানবন্দি থেকেই শুরু ‘হাওয়ালা’ মামলা:
১৯৯১ সালে কাশ্মীর থেকে ধরা পড়ে এক হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গি। আশফাক হুসেন লোন নামে ওই জঙ্গিকে জেরা করতে গিয়েই দেখা যায় কার্যত কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে কেউটে। পুলিশ জানতে পারে হাওয়ালার মাধ্যমেই টাকা আসত ওই জঙ্গি সংগঠনের হাতে। কে দিত সেই টাকা? উঠে আসে শিল্পপতি সুরেন্দ্র কুমার জৈনের নাম। না, তিনি একা নন তাঁর ভাই ও বেশ কয়েকজন আত্মীয়দের সঙ্গেও হাওয়ালা যোগ সামনে আসে। লোনের কথার সূত্র ধরে তল্লাশি শুরু করে সিবিআই। জৈন ও তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতে ঢুকে জোর তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা। বিপুল পরিমাণ ভারতীয় ও বিদেশি মুদ্রার খোঁজ পান তাঁরা। হাতে আসে জৈনের দুটি ডায়েরি আর দুটি নোটবুক। কবে, কাকে, কত টাকা দেওয়া হয়েছিল, তার হিসেব লেখা ওই ডায়েরিতে। ডায়েরির খুলতেই অনেকের মুখোশ খুলতে শুরু করে। একের পর এক দুর্নীতির ছবি সামনে আসে।
জৈনদের সেই ‘বিস্ফোরক’ ডায়েরি:
ডায়েরির পাতায় পাতায় টাকার হিসেব। সঙ্গে কিছু নামের সঙ্কেত। আর সেই সঙ্কেত বিশ্লেষণ করতেই চোখ কপালে ওঠে গোয়েন্দাদের। শুধু জঙ্গি সংগঠন নয়, হাওয়ালাদের মাধ্যমে টাকা গিয়েছে তাবড় রাজনীতিকদের হাতে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত মাসের হিসেবে কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে, সেই তথ্য ছিল ডায়েরিতে। এক-দু’জন নয়, ৪২ জন প্রথম সারির রাজনৈতিকনেতার নাম ছিল সেই ডায়েরিতে। অভিযোগের তালিকায় নাম ছিল রাজীব গান্ধী, এলকে আডবাণী, দেবী রাম, ভিসি শুক্লা, শরদ যাদব, বলরাম জখরের নাম। কত টাকা দেওয়া হয়েছিল তাঁদের? হিসেবটা সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা থাকলেও গোয়েন্দারা খুব সহজেই সেটা বুঝে যান। তিন বছরে একাধিক নেতাকে মোট ৫২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাপা পড়ে যায় সেই ডায়েরির ইতিহাস। পরবর্তীকালে গোয়েন্দারা স্বীকার করেছিলেন, ডায়েরির সত্যতা নিয়ে তাঁরা খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। হতে পারে শিল্পপতি এসকে জৈন গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিতে ওই ডায়রি সাজিয়ে রেখেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেননি কোনও রাজনীতিক।
হাওয়ালা মামলায় নাম থাকায় পদত্যাগ করেন এলকে আডবাণী:
হাওয়ালা মামলা তথা জৈন ডায়রি কেলেঙ্কারিতে যখন নাম জড়ায়, এলকে আডবাণী তখন সাংসদ। কিন্তু দুর্নীতিতে নাম জড়ানোয় পদত্যাগ করেন তিনি। ১৯৯৬-তে পদত্যাগ করেন ও জানান, মামলায় ক্লিন চিট না পাওয়া অবধি তিনি ফিরবেন না। পরে ১৯৯৮ তে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে লোকভায় ফেরেন তিনি। জন সাধারণের কাছে নিজের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে পরে দাবি করেন এলকে আডবাণী।
মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা, প্রাক্তন উপ প্রধানমন্ত্রী দেবী লাল, উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এনডি তিওয়ারি, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নটবল সিং-সহ একগুচ্ছ নাম ছিল সেই তালিকায়।
অভিযোগ, ২০০ কোটি নেন রাজীব গান্ধীও!
জৈনের ডায়েরিতে নাম ছিল রাজীব গান্ধীর নামও। লেখা ছিল আরজি-২০০। সিবিআই সূত্রে দাবি করা হয়, আসলে ২০০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা বলা হয় রাজীব গান্ধীকে। জানা যায়, সিবিআই-কে দেওয়া জবানবন্দিতে সুরেন্দ্র জৈন দাবি করেছিলেন রাজীব গান্ধীকেও টাকা দিয়েছিলেন তিনি। প্রথমে ললিত সুরির হাতে যায় সেই টাকা। তিনি ক্যাপ্টেন সতীশ শর্মাকে সেই টাকা দেন। তিনি টাকা তুলে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর হাতে। শুরু তাই নয়, রাজীব গান্ধী তাঁকে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প পেতেও সাহায্য করেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন সুরেন্দ্র জৈন। কাশ্মীরের উরির সেই পাওয়ার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলেন তিনি।
রিটার্ন গিফটে হিরের গয়না দিতেন অতিথিদের, কে এই সুরেন্দ্র জৈন?
বাবা রাও সাহেব জ্যোতি প্রসাদ জৈন ছিলেন ভারতীয় সেনার আধিকারিক। চার সন্তান সুরেন্দ্র, বলবন্ত, নরেন্দ্র ও অরবিন্দ। পরে জৈন অ্যান্ড রাই কোম্পানি তৈরি করেন তাঁরা। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। খুব তাড়াতাড়ি শিল্পপতি হয়ে ওঠেন বলবন্ত জৈন। সেই পুঁজি থেকেই তৈরি হয় একের পর এক সংস্থা। তৈরি হয় ভিলাই ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশ, ভারত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কের মতো সংস্থাগুলি।
কিন্তু চার ভাইয়ের মধ্যে একেবারে আলাদা ছিলেন সুরেন্দ্র। শুধু বিত্ত নয়, ক্ষমতার লোভও আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে থাকত তাঁকে। তিনি চাইতেন, দেশটাকে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাঁর কথায় ওঠা-বসা করবেন নেতা-নেত্রীরা। তাঁর একটি ফার্ম হাউসে পার্টির আয়োজন করতেন মাঝে মধ্যেই। ফার্ম হাউসটিকে বিলাবহুল বললেই কম বলা হয়। অতিথি তো নয় যেন চাঁদের হাট বসত সেখানে। প্রথম সারির নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে ‘র’ চিফ, কে না থাকতেন সেখানে। শোনা যায়, অতিথিদের হিরের গয়না পর্যন্ত উপহার দিতেন। কিন্তু ১৯৯১-তে ডায়েরি সামনে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সঙ্গে রাজনীতিকদের সমীকরণ বদলে যায়। একসময়ের ঘনিষ্ঠরা দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে। আপাতত জামিনে মুক্ত শিল্পপতি এসকে জৈন।
ডায়েরির পাতা খুলতেই সরতে হল সিবিআই অফিসারদের?
ডায়েরির পাতায় পাতায় নেতা, আমলাদের নাম। খবরের শিরোনামে উঠে আসে হাওয়ালা কেস। জাতীয় রাজনীতি যখন এই মামলা সরগরম হয়ে উঠছে, তখন একটু একটু করে হারিয়ে যায় সেই তদন্ত। যাঁরা এই মামলার তদন্ত করছিলেন, সেই সিবিআই আধিকারিকদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। অভিযোগ, রাজনীতির অঙ্গুলিহেলনেই সরিয়ে দেওয়া হয় গোয়েন্দা অফিসারদের। তবে কি ডায়েরির পাতা সত্যিই নাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজনীতিকদের? সেই প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে হাওয়ালা মামলা:
১৯৯৩-এর ৪ অক্টোবর একটি রিট পিটিশন দাখিল হয় এই হাওয়ালা মামলায়। সেখানে হাওয়ালা-কাণ্ডের সূত্র ধরে দাবি করা হয় সিবিআই-এর মতো সংস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। আবেদনকারী উল্লেখ করেন, জঙ্গিদের মুখ থেকে উঠে আসা তথ্যের সূত্রে মুখোশ খুলে যাচ্ছিল একের পর এক প্রভাবশালীর। তাঁদের স্বার্থরক্ষাতেই মামলা চাপা পড়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। আবেদনে আরও বলা হয়, ওই ঘটনায় দুষ্কৃতীদের সঙ্গে প্রভাবশালীদের যোগসূত্র প্রকট হচ্ছিল। কী ভাবে তাঁরা বেআইনি অর্থের অধিকারী হয়ে উঠছিলেন, সেই পর্দাই ফাঁস হচ্ছিল তদন্তে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের ওই মামলার সঙ্গে জৈন ডায়েরির সরাসরি যোগ ছিলনা। আবেদনের বিষয় ছিল মূলত তদন্তকারী সংস্থার ওপর সরকারের প্রভাব ও সন্দেহজনকভাবে সিবিআই অফিসারদের মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়া। ওই মামলার পর্যবেক্ষণে সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নির্দেশিকা দেয়। সেখানে বলা হয়, কোনও মন্ত্রী সিবিআই আধিকারিককে ২ বছরের জন্য সরিয়ে দিতে পারবে, তবে সিবিআই আধিকারিকেরা কোনও রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই তদন্ত করবে।