প্রহর গোনা প্রায় শেষ। মা আসছেন! ঢাকে কাঠি পড়ল বলে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দেখা যাবে উৎসুক জনতার ভিড়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। তাছাড়া শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান তো নয়, এই পুজো আক্ষরিক অর্থেই যুগ যুগ ধরে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। ধর্ম-জাতপাতের বিভেদ ভুলে মানুষ মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে।
অবশ্য সাধারণ মানুষের মিলনক্ষেত্র হিসাবে দুর্গাপুজোর মণ্ডপকে ব্যবহারের প্রথা আজকের নয়। এ প্রথার শুরু সেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকেই। সেই সময়ে উত্তাল গোটা দেশ। দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে রোজ যোগ দিচ্ছে বঙ্গ মায়ের বীর সন্তানেরা। পুলিশের সঙ্গে লড়াই, সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জ্বালাময়ী ভাষণে প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসছে সাহসী তরুণ তরুণীরা। এমন সময় বিপ্লবী আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলতে ১৯১৯ সালে প্রথম উত্তর কলকাতার বাগবাজারে শুরু হল সর্বজনীন পুজোর। তখন এমনিই কলকাতার পুজো বলতে মূলত বনেদি বাড়িগুলির পুজো। সেখানে আবার সবসময় সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। তার উপর সব সময় সাহেবদের আনোগোনা লেগেই আছে। এমতাবস্থায় বাগবাজারে পুজো করার সিদ্ধান্ত নিলেন এলাকাবাসীরা। সেই সময়ে পুজোর নাম ছিল নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজো। এই পুজোর সঙ্গে জুড়ে গেলেন নগেন্দ্র নাথ ঘোষাল, হেম মুখোপাধ্যায়, দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী লাল চট্টোপাধ্যায়ের মতো সমাজ সংস্কারক ও স্বদেশী কর্মীরাও। তাঁদের উদ্যোগেই সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে যোগাযোগ। এই পুজোর সঙ্গে জুড়ে গেলেন তিনিও। পরবর্তীকালে নেতাজী মেয়র থাকার সময়, ১৯২৮ সালে বাগবাজার সর্বজনীনের পুজোর স্থান পরিবর্তন হয়ে চলে আসে বর্তমানের পুজোর মাঠে। ১৯২৯ সাল থেকে নেতাজীর অনুপ্রেরণায় ওই মাঠেই পুজোকে কেন্দ্র করে শুরু হল স্বদেশী মেলার। বিদেশী পণ্যের পরিবর্তে বিক্রি হতে শুরু হল স্বদেশী সামগ্রী।
এই ঘটনার সাত বছর পরে ১৯৩৭ সালে বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির কয়েকজন মিলে হেদুয়ার কাছে কাশী বোস লেনে শুরু করলেন দুর্গাপুজোর। পুজোর বেদিতে চামড়ার বুট পরে ওঠার সাহস ছিল না পুলিশের। সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে এই দুর্গাপুজোর। পুজোতেও এক অভিনব নিয়ম আনলো বিপ্লবীরা। এক জনের বদলে ১১জন পুরোহিত মিলে শুরু করল মাতৃ আরাধনার। আসলে পুজো করত একজন, আর বাকিরা ছিলেন বিপ্লবীর দল। ছদ্মবেশে মায়ের মণ্ডপেই গোপনে চলত সমিতির কাজ।
শুধু বাগবাজার নয়, পরবর্তকালে উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার একাধিক পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন নেতাজি। সেই তালিকায় রয়েছে আদি লেক পল্লী, কলকাতা ৪৭ পল্লী, কুমোরটুলি, সিমলা ব্যয়াম সমিতি ইত্যাদি। তাঁকে দেখতে এই সব পুজোয় মানুষের ঢল নামতো। আর সেই ভিড়কে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রতী করে তোলার সচেষ্ট ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এই পথে হেঁটেছিলেন চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
আবার বিবেকানন্দ রোডের সিমলা ব্যয়াম সমিতির পুজোর সঙ্গেও রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের যোগ। ঋষি অরবিন্দ ও বাঘা যতীনের এক সময়ের সহযোগী যুগান্তর দলের নেতা বিপ্লবী অতিন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল এই পুজো। এমনকি সেই কারণেই অষ্টমীর দিনটিকে বীরাষ্টমী রূপে পালন করার চল ছিল এই পুজোয়। দেবীর সামনেই চলত লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, কুস্তি, তরোয়াল চালানোর প্রতিযোগিতা। এছাড়াও যাত্রাপালা, কবিয়াল গান, পুতুল খেলা ইত্যাদি বিনোদন মূলক পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে চলত দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টাও। ইংরেজি পত্রিকা ‘অ্যাডভান্স’-এ এই পুজোকে ‘স্বদেশী ঠাকুর’ বলেও চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই হাতের বাইরে চলে যায় যে, ভয়ে তিন বছরের জন্য নিষদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এই পুজো।
তবে কেবল সর্বজনীন পুজোগুলিই নয়, পরবর্তীকালে বহু বনেদি বাড়িও অংশগ্রহণ করেছিল এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে। সরাসরি না হলেও, স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে বহু পরিবার। ডায়মন্ড হারবারের নন্দীবাড়ির সদস্য নিজেই জড়িয়ে পড়েছিলেন আন্দোলনে। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন জেলে। শেষে পুজোর আগে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। সেই বছর থেকেই প্রতিবাদে মায়ের গায়ের বিদেশি কাপড়ের পরিবর্তে পরানো হয় স্বদেশী শাড়ি। আবার কলকাতায় বহু বাড়িতেও পুজোয় বিদেশির পরিবর্তে স্বদেশী সামগ্রী ব্যবহারের চল শুরু হয়। এমনকি দশমীতে বিসর্জনের পরে খালি পায়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে বাড়ি আসতেন অনেকেই। এভাবেই দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পরে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা।