Election: ১৯৫২ থেকে ২০২৪, গণতন্ত্রের নানা চড়াই-উতরাই, নির্বাচনের নানা অজানা গল্প

১৯৫২ সালে পথ চলা শুরু নির্বাচনী গণতন্ত্রের। কীভাবে বাঁক নিল তারপর? কোন কোন চ্যালেঞ্জ এসেছে তার পথে? এগিয়ে চলেছে কোন দিকে? এখন সেই কাহিনীর পালা।

Election: ১৯৫২ থেকে ২০২৪, গণতন্ত্রের নানা চড়াই-উতরাই, নির্বাচনের নানা অজানা গল্প
| Edited By: | Updated on: Apr 09, 2024 | 12:16 PM

ভারতীয় গণতন্ত্রকে বারবার দাঁড়াতে হয়েছে প্রশ্নের সামনে। ৭৫ বছরের এই গণতন্ত্রের কাহিনীতে বারবার ছড়িয়ে পড়েছে রক্তের দাগ। কখনও সেই রক্ত সাধারণ মানুষের, আবার কখনও বা রাষ্ট্রনেতার। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকে হার মানিয়েছিল রাজীবের মৃত্যু। মানব-বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাঁর শরীর। কিন্তু, তাতে থমকে গেল না লোকসভা নির্বাচন।

রাজীব-হত্যার আগেই লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পরেও নির্বাচন চলল একইভাবে। আর সহানুভূতির ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল কংগ্রেস। কিন্তু কমে গেল আসন সংখ্যা। ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছতে পারল না কংগ্রেস। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় ২৪৪টি এল কংগ্রেসের ঝুলিতে। বিজেপি পেল ১২০ টি আসন। জনতা দল ৫৯ আর সিপিএম পেল ৩৫ টি আসন। সরকার গোড়ার পথে হাঁটলো কংগ্রেস।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সেই বৈঠকে রাজীব-পত্নী সনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেস সভানেত্রী মনোনীত করা হল। পরের দিনই সনিয়া জানিয়ে দিলেন, তিনি এই দায়িত্ব নিতে রাজি নন। ২৯ মে আবার বৈঠক বসল। এবার কংগ্রেস সভাপতি মনোনীত হলেন নরসিমা রাও। তার পর প্রধানমন্ত্রী।

উপনির্বাচনে দাঁড়ালেন অন্ধ্রপ্রদেশের নন্দিয়াল কেন্দ্র থেকে। জিতলেন পাঁচ লক্ষেরও বেশি ভোটে। তখনকার নিরিখে রেকর্ড। সেই সুবাদে নরসিমার নাম উঠল গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।

রাজীবের সময় থেকেই নানারকম অর্থনৈতিক সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ফলে ব্যয় বাড়ছিল সরকারের। অর্থনীতির হাল টলমলো। এরকম সময়েই হাল ধরেছিলেন নরসিমহা রাও। কিন্তু এই পিছিয়ে পড়া মরা অর্থনীতিতে খাঁড়ার ঘা দিল উপসাগরীয় যুদ্ধ। একদিকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য মরিয়া নরসিম্হা রাও। অন্যদিকে আবার মাথা চাড়া দিল তীব্র হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন।

রামমন্দির আন্দোলনের আগুনে ঘি পড়লো মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্ক থেকে। প্ররোচনামূলক উস্কানির অভিযোগ উঠল ঠাকরের দল শিবসেনার বিরুদ্ধে। এই হিংসা কেড়ে নিল ৯০০ জনের প্রাণ। হাসপাতাল উপচে পড়ছে আহতদের ভিড়ে। আহত প্রায় ২০০০। নিখোঁজ একশোর বেশি। অনেকের মতে এই দাঙ্গার প্রতিশোধ মুম্বই দেখল ১২ মার্চ, ১৯৯৩। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। কেঁপে উঠলো গোটা শহর।

১৯৯৩-এর জুলাইয়ে পিভির সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনল বিরোধীরা। এ বার অভিযোগ উঠল, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এবং জনতা দলের কিছু বিক্ষুব্ধ সাংসদকে ঘুষ দিয়ে সরকার বাঁচিয়েছেন পিভি। (এই মামলায় ২০০০ সালে পিভিকে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয় দিল্লির বিশেষ আদালত। ২০০২ সালে সেই রায় খারিজ হয় দিল্লি হাইকোর্টে।) তার আগেই অবশ্য ১৯৯৬ সালে জনতার আদালতে হার হয়েছে পিভি-র। কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১৪১টি আসন। বিজেপি পেল ১৬১ টি আসন। জনতা দল ৪৬ টি আসন। সিপিএম ৩২ টি। সিপিআই ১২ টি। সমাজবাদী পার্টি ১৭। বহুজন সমাজবাদী পার্টি পেল ১১ টি আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না কেউ।সনিয়া-পন্থীদের চাপে কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে নরসিম্হা রাওকে। সেই জায়গায় এসেছেন সীতারাম কেশরী।কিন্তু দেশের সামনে প্রশ্ন কে গড়বে সরকার? এই জট ছাড়লো কীভাবে? কোন দিকে এগিয়ে চলল দেশের রাজীনীতি? দেখাব একটা ব্রেকের পর।

কিন্তু সেটাও ম্যাজিক ফিগারের থেকে অনেক কম। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি দেশে কংগ্রেস পেয়েছে ২৮ শংতাংশ ভোট আর বিজেপির আসন সংখ্যা বেশি। কে গড়বে সরকার?

কিন্তু দুসপ্তাহও টিকলো না বাজপেয়ী সরকার। স্বাধীন ভারতে সবচেয়ে কমদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন অটল বিহারি। আবার সংসদের চারদিকে শুধুই রাজনীতির পাটিগণিত। প্রশ্ন, কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? কে চালাবেন সরকার। কংগ্রেসকে প্রস্তাব দেওয়া হল সরকার গঠন করতে। কিন্তু রেস থেকে সরে দাঁড়ালো কংগ্রেস। এবার প্রস্তাব জনতা দলকে। কিন্তু ভিপি সিংও এবার প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলেন না। তাহলে এবার কে? ন্যাশনাল ফ্রন্ট থেকে প্রবীণ সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুকে প্রস্তাব করা হল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য।

পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করা তো দূরের কথা, বছর পেরোয় কিনা সন্দেহ! কংগ্রেসও দ্বিধা বিভক্ত। পার্টির হাল ধরবে কে? আরও এক বার সনিয়া গান্ধীর দ্বারস্থ হলেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা। এ বার আর তাঁদের বিমুখ করলেন না রাজীব-পত্নী।

কিন্তু ৯৮এর ভোটেও ঘুরে দাঁড়াতে পারল না কংগ্রেস। ১৮২ আসন পেয়ে উঠে এল বিজেপি। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন বাজপেয়ী। ১৯৯৮-এর অটলবিহারীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ১৩ মাসের মধ্যেই পড়ে গেল। আবার একটা ভোটের সামনে দেশ। কিন্তু ১৩ মাসের মধ্যেই কীভাবে দেশবাসীর মনে আরও গভীর ভাবে জায়গা করে নিল বাজপেয়ী? ৯৯ এর নির্বাচনে কি ফল হল ভোটের? রাজ্যেও বদলাচ্ছিল মূল ধারার রাজনীতি।

বাংলায় কংগ্রেসের অন্দরে চিঁড় ধরেছিল নয়ের দশকের গোড়া থেকেই। বারবার উঠে আসছিল যুব কংগ্রেসের এক নেত্রীর নাম। বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সিপিএমের বিরুদ্ধে বাংলার রাস্তাঘাটে আন্দোলনের নতুন মুখ।

বামেদের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা এই ক্ষোভ মমতার নজর এড়ায়নি। কংগ্রেসের পুরোনো নেতাদের অনেকটা পিছনে ফেলেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন মমতা।

৯২ সালে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আবার আবার রাস্তায় মমতা। বামেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন একাই। ব্রিগেড থেকে মহাকরণ অভিযান বামেদের রিগিং নিয়ে সরব মমতা। ঝড় তুললেন তিনি। সে ঝড়ে বেসামাল হল লালবাড়ি রাইটার্স। বেসামাল হল কলকাতা।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে সচিত্র ভোটার কার্ডের দাবি নিয়ে রাস্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযানে বাধা দিল পুলিশ। উত্তেজিত জনতা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে চলল মহাকরণের দিকে। রণক্ষেত্রের চেহারা নিল ধর্মতলা চত্বর। জ্যোতি বসুর পুলিশ গুলি চালালো। পুলিশের গুলিতে কলকাতার রাজপথে প্রাণ হারালেন ২১ জন কংগ্রেস কর্মী।

নির্বাচনী নিয়মকানুন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল নয়ের দশকের গোড়াতেই। কিন্তু এবার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের শুরু হল। নির্বাচনী আচরণবিধি প্রয়োগ, ভোটার আইডি, নির্বাচনী প্রার্থীদের ব্যয়ের সীমা- এই রকম কাজগুলোতে হাত দিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশান।

এই নয়ের দশকের শেষ পর্বেই বাংলাতে বাঁক নীল রাজনীতির মূলধারা। বাংলায় কংগ্রেসের অন্দরে চিঁড় ধরেছিল নয়ের দশকের গোড়া থেকেই। কংগ্রেসের দাপুটে নেতা সোমেন মিত্রের সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির আসন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে উঠল। ১৯৯৮। পয়লা জানুয়ারি। রাজ্যে ভেঙে গেল কংগ্রেস। মমতার নেতৃত্বে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ। সেই বছরই লোকসভা ভোটে ৭টি আসন পেল তৃণমূল আর ৯৯ -এ ৮ টি। এনডিএ জোটে শামিল হলেন মমতা। ১৮২ টি আসন পেয়ে আঞ্চলিক দলের সমর্থনে এনডিএ জোট ক্ষমতায় এল।

অটল বিহারি বাজপেয়ির হাত ধরেই ১৯৯৮ সালে পরমাণু শক্তিতে একধাপ এগিয়ে গেল ভারত। ১৯৭৪ সালের মে মাসে পোখরানে পরমাণু বোমা ফাটিয়েছিলেন ইন্দিরা। ভারতকে পরিণত করেছিলেন বিশ্বের ৬ নম্বর পরমাণু-শক্তিধর দেশে। আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন বাজপেয়ী।

বাজপেয়ী সরকারের সময়েই আবার মেঘ ঘনাল সীমান্তে। কারগিল সেক্টরে ঢুকে পড়ল পাক হানাদাররা। কীভাবে সামাল দিলেন অটলবিহারী? বিশ্বের কাছে কীভাবে তুলে ধরলেন পাকিস্তানের মনোভাব? প্রতিবেশীকে জবাব দিতে কী কী পদক্ষেপ করলেন তিনি? দেখাব, একটা ব্রেকের পর।

১৯৯৯। পাকিস্তানের কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেন বাজপেয়ী। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লি-লাহোর বাস পরিষেবার ঐতিহাসিক উদ্বোধন হল। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেও যাতে দুই দেশ রাশ টানে সেই চুক্তিও স্বাক্ষরিত হল নাওয়াজ শরীফের সঙ্গে।

কিন্তু পাকিস্তান! সে কি অত সহজে বন্ধুত্বের হাত বাড়াবে ভারতের দিকে! পাকিস্তানে তো সরকার টিকেই থাকে ভারত বিরোধিতার মন্ত্র জপ করে। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ১৯৯৯-এর মে। ভারতকে আক্রমণ করল পাকিস্তান। নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে মুশকো, দ্রাস, কাকসার এবং বাতালিক সেক্টর, কার্গিল সেক্টরে ঢুকে পড়েছিল পাক হানাদাররা। ন্যাশনাল হাইওয়ে 1 -এর চিহ্ন মুছে দিতে চাইল পাক হানাদাররা। বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা শ্রীনগর আর জম্মুকে।

যুদ্ধের ময়দানে পা দিল ভারতীয় সেনা। প্রায় তিন মাস ধরে চলল যুদ্ধ। লঞ্চ করা হল অপারেশন বিজয়। ১৯৯৯-এর ৯ জুলাই। টাইগার হিল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল পাকিস্তানিরা। কিন্তু শেষমেশ রিপিট হল ৬৫ বা ৭১-এর। জয় হল ভারতের। টাইগার হিলে আবার উড়লো জাতীয় পতাকা। অটল বিহারি বাজপেয়ী পাকিস্তানকে শুধু সামরিক ভাবেই নয় গোটা বিশ্বের সামনে কূটনৈতিক ভাবেও পর্যদস্তু করলেন।

কার্গিল জয়ই সুগম করল বাজপেয়ির ৯৯-এ জয়ের পথ। বাজপেয়ী সরকারের আমলেই, ২০০৩-০৪ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ার রিজার্ভ ১৯৯৮ সালের 32.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০০৩-০৪ সালে হল ১১৩ বিলিয়ন ডলার। এনডিএ সরকার লঞ্চ করল ইন্ডিয়া শাইনিং প্রোগ্রাম। কিন্তু কেন মুখ থুবড়ে পড়েছিল ইন্ডিয়া শাইনিং? ২০০৪ সালে কাজের খতিয়ান দেখিয়ে কেন ক্ষমতায় আস্তে পারল না বিজেপি? আবার কেন হাওয়া ঘুরল কংগ্রেসের দিকে? কী হল ২০০৪ সালের ভোটের ফল? দেখাব নিউজ সিরিজ ভোটযুদ্ধ দেশের লড়াইয়ের পর্ব ছয়ে।

Follow Us: