‘রান্নাঘর’। বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রান্নার শো ১৫ বছর পার করে ফেলল। সপ্তাহভর সেলিব্রেশন চলেছে। বিভিন্ন অতিথিদের নিয়ে সেলিব্রেট করেছেন সঞ্চালিকা সুদীপা চট্টোপাধ্যায় (Sudipa Chatterjee)। মূলত এই শো-এর মাধ্যমেই যিনি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কেমন ছিল এই জার্নি? পাশাপাশি ‘রান্নাঘর’ নিয়ে সাধারণ দর্শকের কিছু অদ্ভুত কৌতূহলও থাকে। তারও নিরসন করলেন একান্ত সাক্ষাৎকারে।
১) ১৫ বছর একটা শো চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, নেহাত সহজ কাজ নয়। তাও আবার রান্নার শো। যদিও মাঝে বিরতি নিয়েছিলেন। কিন্তু এই লম্বা জার্নি পেরিয়ে প্রথম দিনের কথা ভাবলে, কোনটা মনে পড়ে?
প্রথম দিনের কথা ভাবলে মনে পড়ে মুনমুন সেনের হো চি মিন সরণির ফ্ল্যাট। যেখানে ‘জি বাংলা’র অফিস তৈরি হয়েছিল। বাথরুমে একটা বাথটব ছিল। সেটা দর্শনীয় বস্তু ছিল। আমরা দেখতে যেতাম। কিছু করে দেখানোর জন্য দু’ সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল আমাদের। এই শোয়ের আগে ‘বেণুদির রান্নাঘর’, ‘নন্দিনীর রান্নাঘর’ খুব হিট ছিল, এটা মাথায় ছিল আমার। একজনের উত্তমকুমার ছিলেন। আর একজনের স্বামী তাপস পাল। ফিল্মি ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল দু’জনেরই। লোকে অনেক কিছু জানতে চায় তাঁদের কাছে। ওঁদের ঝুলিতে অনেক গল্প। আমি তখন সামান্য নিউজ় রিডার। আমাকে লোকে কেন দেখবে? সেই অর্থে ডিরেকশন দেওয়ার কেউ ছিলেন না। তখন আমি ভাবলাম, গেস্টকে যদি সেলেবের মতো ট্রিট করি, সেলব ফিল করাই, সেলেবের মতো প্রশ্ন করি, দেখি তো কেমন হয়। সেটাই ক্লিক করেছিল। আমি ঠিক করেছিলাম, আপনার মানে অতিথির কথা শুনব। যাঁরা সংসার চালান, সেই মেয়েদের কথা শুনব। একটা সময়ের পর আর তাঁদের কথা কেউ শুনতে চান না। তিনি সবার কথা শোনেন। ছেলে-মেয়ে কী খাবে, শাশুড়ির মলম এসছে কি না, সব খোঁজ তাঁকে রাখতে হয়। বাড়ির কাজের মেয়েকেও রিলিফ দিতে তিনি থাকেন। কিন্তু তাঁর কথা কেউ শোনেন না। স্বামী ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফেরেন। ছেলে-মেয়েদের নিজস্ব জীবন হয়ে গিয়েছে। আমি ঠিক করলাম তাঁদের কথাই শুনব। সেটাই বোধহয় দর্শক ভালবেসেছিলেন। একটা দিন তাঁর কাটবে সেলেবের মতোই। ফলে টিভির ওপার থেকে দেখছেন যিনি তিনি ভাবছেন, আমিও যাব। আর আমাকে ভালবেসেছিলেন প্রথম দিন থেকে। সেই অর্থে প্ল্যান করে করা হয়নি। এটাই প্রথম দিন অ্যাঙ্কারিং করতে গিয়ে ভেবেছিলাম।
২) রান্নার শো জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সবথেকে চ্যালেঞ্জিং কোন বিষয়টা?
রান্না। এখন মিটিং করি যখন, কী রাঁধব, কোন রান্নাটা করিনি সেগুলো ভাবতে হয়। গত ১৫ বছরে কোন রেসিপি হয়নি, সেটা ভেবে বের করতে হয়। সব রকমই তো দেখিয়েছি। সাধারণ রান্না, বিদেশি রান্না, অবাঙালি রান্না, মাইক্রোয়েভের রান্না… সব দেখিয়েছি। কী নতুন তবে? এখন রান্নার পাশাপাশি মানুষকে সাহায্য করারও চেষ্টা করি। ‘রান্নাঘর’ আমি তো বলব, সেই ম্যাগাজ়িন যেখানে সব সাহায্য পাওয়া যায়। জবা গাছে কোন সার দেবেন, শার্টের কলারের দাগ তুলবেন কী ভাবে, সেটাও বলি। রান্না কতটা পকেট ফ্রেন্ডলি করা যায় সেটা বলি। এই করোনার সময়ে ইমিউনিটি বাড়াতে সকলে বলছেন, কাঁচা হলুদ খান। কিন্তু কাঁচা তো চিবিয়ে খাব না। কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে রান্নায় ব্যবহার করব, সেটা দেখাই। মানুষের জীবনের অংশ হয়ে তার জীবনের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করি। এখন কথা শোনার জন্য রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রয়েছেন। ‘দিদি নম্বর ওয়ান’। সেখানেও যে দিদিরা আসেন, তাঁদের জীবনের গল্প শোনা হয়। ‘রান্নাঘর’ যখন শুরু হয়েছিল, তখন কিন্তু রচনা ছিলেন না। ফলে আমরা দেখাই, হাউ টু মেক লাইফ ইজ়িয়ার। কী করে সঞ্চয় করতে হবে, সেটাও বলে দিই।
৩) এত রকম অতিথি আসেন রান্না করতে। অনেকেই অভিজ্ঞ, অনেকে হয়তো রান্না নতুন করছেন। এমন কখনও হয়েছে, অতিথি কোনও ভুল পদ্ধতি দেখাচ্ছেন, বা ভুল তথ্য দিচ্ছেন, সেটা সংশোধন করে দিতে পেরেছেন?
প্রত্যেক শিডিউলেই এটা হয়। এখানে যাঁরা আসেন, বেশিরভাগই প্রথমবার ক্যামেরা ফেস করেন। বাড়িতে হয়তো তাঁরা রান্না করতে দারুণ ওস্তাদ। এখানে এসে দারচিনি বলতে গিয়ে দু’বার ভাবছেন। আমি তো বডি মাসাজও করে দিই। রিল্যাক্স করে দিই। ক্যামেরাম্যানদের বকাঝকা করে দিই। ওরা নিজেদের মধ্যে টক-ব্যাকে কথা বলে। এই কথাগুলো শোনা যায়। কারণ আমাদের শো-এ অ্যাঙ্কর আর গেস্টের খুব বেশি ডিসট্যান্স থাকে না। ফলে গেস্ট টক-ব্যাকের কথা শুনতে পান। আরও নার্ভাস হয়ে যান। তখন বকি ক্যামেরাম্যানদের। এগুলো গট-আপ থাকে (হাসি)। গেস্টকে সাবলীল করার জন্য বলি, চা খাবেন? চলুন এক কাপ চা খাই। বসে কথা বলি গেস্টের সঙ্গে। তারপর শুটিং।
৪) অনেকে এই শো-এর সাজানো রান্নাঘর দেখে রান্না করতে উৎসাহী হন। কিন্তু বাড়ির রান্নাঘর তো আর শো-এর সেট নয়। ফলে প্রাথমিক চাকচিক্যের মোহ চলে গেলে আর রান্না করার উৎসাহ পান না। এই ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন?
লক্ষ্য করলে দেখবেন, রান্নাঘরের সেটটা মাঝেমাঝে বদলে যায়। খুব ব্যয়বহুল সেট আমাদের নয়। বরং সবচেয়ে কমদামি সেট। বাজেট নেই বলে নয়। ইচ্ছাকৃত করি আমরা। হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন জিনিস দিয়ে সাজাই সেট। কখনও বই এসে যায় তাকে। কখনও মাটির জিনিস দিয়ে সাজাই। আমার রান্নাঘরে যে বয়ামটা অতিথি দেখলেন, সেটা কেনার ইচ্ছে হবে তাঁর। তিনি সেটা যাতে হাতের কাছে পান, সাধ্যের মধ্যে পান, সেই চেষ্টা করি। জাতীয় স্তরের রান্নার শো-এ যে বাসনপত্র ব্যবহার হয়, তা আমরা রাখি না। কারণ এতে গেস্টের থেকে দূরে সরে যাব। এখন ওপেন কিচেনের কনসেপ্ট যেটা, আমাদের সেটা করা হয়েছে। রান্না করতে-করতে গল্পও করব। হয়তো তেল কালিঝুলি নেই। সেটা আমরা পরিষ্কার করি বলে। অনেক সময় দেখবেন, অ্যাঙ্কারিং শুরু করি কোনও জিনিস মুছতে-মুছতে। কীভাবে পরিষ্কার করবেন, সেটাও বলে দিই। যাতে কানেক্ট করতে পারেন দর্শক।
৫) এই শো-এর মাধ্যমে আপনার একটা বাড়ির মেয়ের ইমেজ তৈরি হয়েছে। সেটা কি সচেতন ভাবে তৈরি?
হ্যাঁ। কারণ অগ্নিদেবের (চট্টোপাধ্যায়, পরিচালক) সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরে আমার ঝুলিতেও ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কিত অনেক গল্প এসেছে। আর এই চ্যানেলের অ্যাঙ্কার কারা? মিঠুন চক্রবর্তী, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়… সব সুপারস্টার অ্যাঙ্কার। তাঁদের পাশে আমি দাঁড়াব কী করে? ওঁদের কোনও দিনই টেক্কা দিতে পারব না। ফলে সে চেষ্টাও করিনি। নিজের শিক্ষা আর রুচি দিয়ে কাজ করেছি। আমার শো-এ ভুলও রিটেক করতে দিইনি। ধরুন, ফোড়ন দিয়েছি। কিন্তু তেজপাতা আগে দেওয়ার কথা ছিল, ভুলে গিয়েছি। সেটাও ক্যামেরায় বলেছি। এটা কিন্তু কোনও স্টার করবেন না। স্টার কোনও ভুল রাখবেন না।
৬) সাধারণ দর্শকের যে কোনও রান্নার শো নিয়ে কিছু কৌতূহল থাকে। তেমনই কয়েকটা প্রশ্ন করছি। আপনি কৌতূহল নিরসন করুন। যেমন- শো-এ রান্না কি সত্যি হয়?
যাঁরা ‘রান্নাঘর’ ফলো করেন, দেখবেন খেয়াল করে, এক শাড়ি পরে দু’টো এপিসোড করেছি। একটা কয়েকদিন আগে টেলিকাস্ট হয়েছে। একটা পরে। ধরুন, পাঁঠার মাংস রান্না করছি, করতে তো সময় লাগে। যেটা রান্না হয় সেটাই দেখাই আমরা। খেয়াল করে দেখবেন, হয়তো মাংসটা সেদ্ধ করতে কড়াইটা ঢাকা দিলাম। তারপর ব্রেক নিলাম। এ বার মাংসটা ব্যাক কিচেনে চলে গেল। সেদ্ধ হলে আবার ওই এপিসোড শুট হবে। তার মাঝে অন্য এপিসোড শুট হয়ে গেল। গেস্টকে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে বলি। আমরা খাবারের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ় করি না। আমি তো গার্ল নেক্সট ডোর। ফলে নতুন শাড়ি রোজ পরতে হবে, এই চাপটা আমার নেই। আপনারাও তো এক শাড়ি কতবার পরেন। আমারও পরতে ইচ্ছে হয়, তাই পরি (হাসি)।
৭) রান্না করা খাবার কেমন খেতে হয়? প্রতিটি রান্না টেস্ট করার পর আপনি প্রশংসা করেন। সত্যিই কি সব রান্না প্রশংসা করার মতো?
‘রান্নাঘর’-এর শুরুতে কিছু রান্না সত্যিই হয়তো ভাল হয়নি। তখন বলতাম, নুন বেশি। বা মিষ্টি একটু হলে ভাল হত। আমাদের প্রোগ্রামিং হেড এখন বলেন, “এখানে এসে কেউ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরবে না।” সে কারণে আমরা এখন প্যানেল ঠিক করেছি এক্সপার্টদের নিয়ে। তাঁদের কাছে আগে থেকেই রেসিপি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা সাজেস্ট করেন, কোনও রেসিপিতে হয়তো টক দই না দিয়ে মিষ্টি দই দিলে ভাল হবে, সেটা তাঁরা আগে থেকে বলে দেন। রেসিপির ভুল থাকলে শুরুতেই রেক্টিফাই করে দিই। কাউকে মন খারাপ করে যেতে দিই না। শুরুর দিকে সত্যি বলতে গিয়ে ভুলই হয়েছিল। অনেকেরই অন ক্যামেরা রান্না ততটা ভাল হয়নি শুনতে হয়তো ভাল লাগেনি। এখন আর সেটা হয় না। এখন রান্না সত্যিই ভাল হয়।
৮) এই সব রান্না করা খাবার কারা খান?
‘দিদি নম্বর ওয়ান’ আর ‘রান্নাঘর’ একটা ফ্লোরেই শুট হয়। লাগোয়া ফ্লোরে ‘দাদাগিরি’, ‘সারেগামাপা’, ‘ডান্স বাংলা ডান্স’-এর শুটিং হয়। ‘দাদাগারি’র শুটিং চললে এমন কোনও রেসিপি হয়তো হয়েছে, যেটা জানি দাদার ভাল লাগবে, সেটা পাঠাই। তারপর ওদের সেটেই বিলীন হয়ে যায়। আমাদের একটা মজার সিক্রেট আছে। বলছি সেটা (হাসি)। এখানে রান্না হওয়ার পর যদি বলা হয়, ‘বিক্রি আছে’, পরিচালক মাইকে ধরুন বললেন, ‘বিক্রি আছে’। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে খেয়ে নেয়। আর ‘বিক্রি হবে না’ বললে, খাবারটা অন্য ফ্লোরে যাবে। খাবার এই সেটে খাওয়া হবে, নাকি ওই সেটে যাবে সেটা নির্ধারণ করে দেয় ওই বাক্যটা (হাসি)।
৯) প্রয়োজনীয় উপকরণ কারা কিনে দেন? কারা সবজি কেটে, বাটনা বেটে দেন?
আমাদের সেটের পিছনে ডাবল সাইজের ব্যাক কিচেন আছে। ওখানে ছ’জন ছেলে, দু’জন মহিলা কাজ করেন। তাঁরা কুটনো কাটা, বাটনা বাটার মতো কাজ সব করে দেন। আর উপকরণ কেনার বাজেট অবশ্যই চ্যানেলের তরফ থেকে দেওয়া হয়।
১০) আপনি সঞ্চালিকা হিসেবে কতটা রান্না করেন?
আমি রান্না নিয়ে খুব পজ়েসিভ। আমার একার রান্না থাকলে ব্যাক কিচেন তটস্থ হয়ে থাকে। মাংসর কিমা এতটাই থাকবে, নাকি আরও কেটে দেবে, সেটাও দেখিয়ে নেয় আমাকে। ব্রেকের সময়ও আমি দাঁড়িয়ে থাকি (হাসি)। আসলে পারফেক্ট করতে চাই সব কিছু। রান্না করতে-করতে তেল ছিটে বার্নারে পড়লে তখনই ড্রয়ার থেকে টিস্যু বের করে মুছতে থাকি। আমার দেখলেই মনে হয় তেলের দাগ হয়ে যাবে। আসলে কাজটা এনজয় করে করি। এমন নয়, শুটিং হিসেবে করি।
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ