
২০১৯-এর ভারতীয় জনতা পার্টির দিল্লি সদরের ছবিটা ছিল ঠিক এমন। হাসিমুখে, গেরুয়া উত্তরীয়তে, হাতে ভিক্ট্রি সাইনে টলিতারকারা। তালিকায় পার্নো মিত্র, মৌমিতা গুপ্ত, রূপাঞ্জনা মিত্র, রূপা ভট্টাচার্য, কাঞ্চনা মৈত্র। এই ছবিতে না দেখা গেলেও, সেই সময় বা তারপর গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন ঋষি কৌশিক, কৌশিক রায়, বনি সেনগুপ্তর মতো অভিনেতারাও। গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়ে তাঁরা স্পষ্টই বলেছিলেন বাংলার মসনদে পরিবর্তনের কথা। কিন্তু এই পুরো চিত্রটাই বদলে গেল ২০২১ -এর বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে। বদলে গেল বিজেপির তারকাপ্রার্থীদের অবস্থান। ২০১২ সাল থেকে শুরু হলেও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় টলিউড স্টুডিও পাড়ার রাজনীতিতে এক বড়সড় বদল এসেছিল। গেরুয়া শিবিরের শক্তিবৃদ্ধি করতে ঝাঁকে ঝাঁকে অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা দিল্লিতে গিয়ে বিজেপির পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই উন্মাদনা অনেকটাই আজ ফিকে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ ঘাসফুল শিবিরের সদস্য, আবার কেউ কেউ রাজনীতিকে পাকাপাকিভাবে বিদায় জানিয়েছেন। শুক্রবার বিজেপি ছেড়ে পার্নো মিত্রর তৃণমূলে যোগদান করার পর থেকেই রাজনীতির মহলের আলোচনার কেন্দ্রে, ২০১৯-এর বিজেপি সদরের সেই ছবি।
রাজনীতিতে যোগ দিলেও বাস্তব রাজনীতির লড়াই এবং দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকেই রাজনীতি ছেড়েছেন টলিতারকারা। যার মধ্যে প্রথমেই আসে ঋষি কৌশিক ও রূপাঞ্জনা মিত্রর নাম। ২০১৯-এ বড় আশা নিয়ে যোগ দিলেও বর্তমানে ঋষি কৌশিক রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন। তবে রূপাঞ্জনা ২০২৫ সালে বিজেপি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। ঋষি কৌশিকের মতো একই পথে হেঁটেছেন অভিনেত্রী রূপা ভট্টাচার্যও। বিজেপির একসময়ের অত্যন্ত সোচ্চার এই অভিনেত্রী দলের কার্যপদ্ধতি নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়ে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তালিকায় রয়েছেন, অভিনেত্রী অঞ্জনা বসুও। ২০২১-এ প্রার্থী হলেও বর্তমানে তাঁকে আর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা যায় না। তিনি পুনরায় নিজের অভিনয় কেরিয়ারেই মনোনিবেশ করেছেন। তথ্য অনুযায়ী, মৌমিতা গুপ্তও বিজেপিতে খুব একটা সক্রিয় নন, তাঁকে দেখা যায় না গেরুয়া শিবিরের কর্মসূচীতে। রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান খুব একটা স্পষ্ট নয়।
২০২১ সালের ১ মার্চ ঘটা করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন টলিউডের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়। বেহালা পশ্চিম কেন্দ্র থেকে হাই-প্রোফাইল প্রার্থী হিসেবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তিনি। কিন্তু হারের পর দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। অবশেষে ১১ নভেম্বর ২০২১-এ বিজেপির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বর্তমানে শ্রাবন্তী সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ না দিলেও তৃণমূলের একাধিক সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়, তাঁর এই উপস্থিতি ইদানিং তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা-চিন্তার ইঙ্গিত দেয়।
শ্রাবন্তীর পথ ধরে পায়েল সরকারও বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ওই একই সময়ে। বেহালা পূর্ব কেন্দ্র থেকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। হারের পর শ্রাবন্তীর মতো দল ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা তিনি না করলেও, দলের কোনো কর্মসূচিতে তাঁকে আর দেখা যায় না। জানা যায়, পায়েল বর্তমানে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ দূরত্ব বজায় রাখছেন। নিজের অভিনয় কেরিয়ারে তিনি বেশি সময় দিচ্ছেন।
শ্রাবন্তী ও পায়েলের মতোই টলিউডের বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় মুখে সরাসরি শাসকদলে নাম না লেখালেও, তৃণমূলের নানা অনুষ্ঠানে তাঁদের মঞ্চে দেখা যায়। যেমন, নীল-তৃণা, সৌমিতৃষা কুণ্ডু, রণিতা দাস ও সৌপ্তিক চক্রবর্তী, শ্রীতমা ভট্টাচার্য,মানালি দে। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে এদের মধ্যে কেউ সরাসরি রাজনীতিতে আসবেন কিনা তা অবশ্য সময়ই বলবে।
এরই পাশাপাশি রাজনীতির মঞ্চে আরেক তত্ত্বও উঠে এসেছে। বিজেপির অনেক নেতাই মনে করছেন, যে শিল্পীরা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা নাকি টলিউডে কাজ পাওয়ার জন্যই এমনটা করতে বাধ্য হয়েছেন। বিজেপিতে নাম লেখানোর ফলে নাকি টলিউডে কাজ হারাচ্ছিলেন এই সেলিব্রিটিরা, এমনও কানাঘুষো রয়েছে স্টুডিওপাড়ায়। এমনকী, পার্নোর তৃণমূলে যোগদান করার পর এমনটাই বলেছেন বিজেপি নেতা সজল ঘোষ। অন্যদিকে পার্থ ভৌমিক টিভি নাইন বাংলাকে জানান, ”এরকম প্রচুর মানুষ রয়েছেন, যাঁরা তৃণমূল করেন না, কিন্তু চুটিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, অসংখ্য উদাহরণ রয়েছেন। তাহলে তাঁরা কাজ পাচ্ছেন কীভাবে! টলিউডের কাজের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস পার্টির সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, সরকার পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সব সেক্টরে প্রতিনিধিত্ব থাকা দরকার। যাতে প্রত্যেক সেক্টরের সরকারে একটা প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সেই কারণেই তৃণমূলে অনেকে প্রার্থী, বিধায়ক, সাংসদ হয়েছেন। নাটকের থেকেও হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের থেকেও হয়েছে, ট্রেড ইউনিয়ান থেকেও হয়েছে। যেকোনও জায়গারই মানুষ প্রতিনিধিত্ব করছে। যাঁরা এই ধরনের কথা বলেন, তাঁরা হতাশ হয়ে একথা বলেন। তাঁরাও জানেন, টলিউডে প্রচুর মানুষ রয়েছেন, যাঁরা তৃণমূল করেন না, তবুও মাথা উঁচু করে কাজ করছেন।”
তবে এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত, এই মহূর্তে বিজেপির ঘর আলো করে রাখা তারকাপ্রার্থীদের কথাও। অর্থাৎ, মিঠুন চক্রবর্তী, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকারা। এরা প্রথম থেকেই বিজেপিতে শক্ত জমি খুঁজে পেয়েছেন। রয়েছেন নানা পদেও। প্রায় প্রত্যেকেই গেরুয়া শিবিরের মঞ্চে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পুজোর ছবি রঘু ডাকাতে দেবের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, কয়েক মাস আগেই মুক্তি পায় রূদ্রনীল ঘোষের অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস ছবি। অন্যদিকে বড়দিনের বক্স অফিসে চলছে মিঠুন ও দেব জুটির প্রজাপতি ২।