প্রার্থীদের মোবাইল নম্বর শেয়ার করে পরে ডিলিট, কী বলছেন সেই তারকা-প্রার্থীরা?

‘অল ইন্ডিয়া বিজেমূল পার্টি’ ফেসবুক পেজটি একটু ঘাঁটলে আরও পরিস্কার হয়ে যায় যে একেবারে তৃণমূল এবং বিজেপিকে কটাক্ষ করা মূল লক্ষ্য পেজের।

প্রার্থীদের মোবাইল নম্বর শেয়ার করে পরে ডিলিট, কী বলছেন সেই তারকা-প্রার্থীরা?
ভাইরাল হল ফোন নম্বর।
Follow Us:
| Updated on: Apr 26, 2021 | 11:39 PM

একটি ফেসবুক পেজের পোস্ট। পোস্টে লেখা, ‘মানুষের জন্য কাজ করতে যেসব দলবদলুরা ভোটে দাঁড়িয়েছে, এফিডেভিট থেকে তাদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছি। ওগুলো ভাইরাল করব এবার। রেড ভলান্টিয়ার্সদের নাম্বার তো ভাইরাল, এবার “মানুষের জন্য কাজ” করতে চাওয়া গিরগিটিদের মোবাইলেও মানুষের ফোন ঢুকুক।’ এবং তারপর সেই পোস্টে ভোটপ্রার্থীদের নাম এবং ফোন নম্বর। একের পর এক হেভিওয়েট প্রার্থী। মুকুল-শুভেন্দু-বৈশালী ডালমিয়া থেকে শুরু করে সায়নী ঘোষ, পার্নো মিত্র, রুদ্রনীল ঘোষ। মোট ১৪ জনের নাম এবং ফোন নম্বর লেখা এক ছবি পোস্ট করা হয় ‘অল ইন্ডিয়া বিজেমূল পার্টি’ ফেসবুক পেজে। পরে অবশ্য নাম-নম্বরের ছবিটি ডিলিট করা হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। সেই ছবি এখন ফেসবুকে ভাইরাল, শেয়ার হয়েছে বিভিন্ন ফেসবুক ওয়ালে।

 

আরও পড়ুন ‘রেড ভলেন্টিয়ার’দের সাহায্যের পোস্ট শেয়ার করেও কেন মুছলেন? ‘ঋদ্ধির অনুরোধে’, মুখ খুললেন রাজ

 

‘অল ইন্ডিয়া বিজেমূল পার্টি’ ফেসবুক পেজটি একটু ঘাঁটলে আরও পরিস্কার হয়ে যায় যে একেবারে তৃণমূল এবং বিজেপিকে কটাক্ষ করা মূল লক্ষ্য পেজের। এই তৃণমূল ও বিজেপি-বিরোধী পেজ কি তাহলে বামফ্রন্টের সমর্থক? পেজের অ্যাডমিন সিপিআইএম নেতা এবং সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ফেসবুকের ওই পেজটি আমাদের পার্টির কোনও পেজ নয়। শুনেছি একটি ছেলে চালায়। ছেলেটি পার্টির সদস্য নয়। ওই পেজেই দেখলাম সে দাবি করেছে এফিডেভিট থেকে নম্বর পেয়েছে। কিন্তু কেন এমন করেছে, সে বিষয়ে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি।”

 

 

 

পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্যও সেই ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘‘যাঁরা যাঁরা মানুষের জন্য কাজ করবেন, কিন্তু করে উঠতে পারছিলেন না বলে অনুযোগ করেছিলেন, তাঁদের নাম্বার আর যোগাযোগের সমস্ত ডিটেলস সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হোক। এত বড় সুযোগ তো আর পাবেন না। ওঁদের সাথে আপদে বিপদে যেন যোগাযোগ করা যায় আর কে কেমন রেসপন্স করলেন তারও যেন ডিটেলস সেই পেজ থেকে পাওয়া যায়। বড় উপকার হয় যদি একদম ব্যক্তিদের যোগাযোগ ডিটেলস দিয়ে এরকম একটা পেজ বা ওয়েবসাইট পাওয়া যায়।

যদি কেউ কারও নাম্বার জেনে থাকেন শেয়ার করতে থাকুন। প্রয়োজনে ফোন করুন, কী রেসপনস করছে জানান। তুলকালাম করে দিন। বি: দ্র: বাবুল সুপ্রিয় এবং পার্নো মিত্র কোভিড পজিটিভ, ওঁদের অবশ্যই এই তালিকা থেকে এখন বাদ রাখা উচিত। দ্রুত সেরে উঠুন।’’

TV9 বাংলার পক্ষ থেকে পরিচালককে ফোনে ধরা হলে তিনি বলেন, “আমরা বক্তব্য খুব সহজ, এখনই তো সুযোগ কাজ করার, হাসপাতালে বেড নেই অক্সিজেন সিলিন্ডারের ক্রাইসিস। এই মানুষগুলো যদি সাহায্য না করে কারা করবেন? তাঁদের সাহায্য করার স্পেস তো অনেক বেশি। আমি তো পোস্টে এটাও লিখেছি, যাঁরা সাহায্য করছেন, তাঁদের নামও উল্লেখ করা হোক। মানুষই লিখবেন তাঁদের নাম।”

 

 

 

কিন্তু এ ভাবে ব্যক্তিগত ফোন নম্বরের স্ক্রিনশট শেয়ার করা কি আদৌ নৈতিক? উত্তরে ইন্দ্রাশিস বললেন, “ওঁরা তো জনসেবা করার উদ্যোগ নিয়েই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। আর সেই মানুষই তো তাঁদের সমস্যার কথা জানাবেন।”

অনুমতি ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় এভাবে মোবাইল নম্বর শেয়ার করা নিয়ে যোগাযোগ করা হয় সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ তথা আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন “২০১৯ সালের পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন বিল যতক্ষণ না পর্যন্ত আইনে রূপান্তর হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও জনসাধারণের প্রাইভেসি বিঘ্নিত হলে ক্রিমিনাল কোর্টে মামলা করতে পারবেন না। ২০১৭ সুপ্রিম কোর্ট গোপনতার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর মানুষ হাইকোর্টে রিট ফাইল করতে পারেন। তবে ফোন নম্বরে কল করে যদি কোনও হুমকি অথবা ভয় দেখানো হয়, তাহলে মামলা করা যাবে। পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন আইন পাশ হওয়ার পর কিন্তু পার্সোনাল ডেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় অনৈতিকভাবে শেয়ার করা জামিনঅযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং তিন বছর আবধি জেলও হতে পারে।”

ফেসবুক পোস্টটির পর কেটে গিয়েছে প্রায় ২৪ ঘন্টা। নিজেদের ফোন নম্বর ‘ভাইরাল’ হওয়ার পর ঠিক কী অবস্থার সম্মুখীন তারকা-প্রার্থীরা? জানালেন নিজেরাই:-

 

রুদ্রনীল ঘোষ (বিজেপি প্রার্থী, ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র)

“মজার কথা হল, এখানে কোন সিপিএম নেতা বা প্রার্থীর নাম নেই। কারা করতে পারে এটা সবাই জানে।”

 

যশ দাশগুপ্ত (বিজেপি প্রার্থী, চণ্ডিতলা বিধানসভা কেন্দ্র)

“গতকাল থেকে আমি ৫০০০-এরও বেশি কল পেয়েছি। এখনও আমার ফোন নন-স্টপ বেজে যাচ্ছে। অমি মনে করি যারা এটা করেছে তারা মানুষের ভাল করার জায়গায় ক্ষতি করেছে কারণ আমরা যারা অ্যাকচুয়াল কাজগুলো করে ছিলাম, কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করা, কাউকে অক্সিজেন সাপ্লাই করানো, সেইগুলো এখন দেরি হচ্ছে। যাদের সত্যিকারের প্রয়োজন তাঁরা ফোনে ধরতে পারছে না, করাণ ব্যস্ত আসছে। এমনিতেও আমার ম্যানেজার ওই ফোনটা হ্যান্ডেল করত। এখন ওকে হোয়াটস অ্যাপ দেখে আলাদা করতে হচ্ছে কাদের সাহায্যের দরকার, আমি তাঁদের কল করছি।  আজকাল সোশ্যাল মিডিয়া একটি খুব শক্তিশালী হাতিয়ার যা ভাল এবং খারাপের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটি এমন এক শক্তি যার জন্য সবসময় সতর্ক হওয়া উচিত।”

 

রাজ চক্রবর্তী (তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী, বারাকপুর বিধানসভা কেন্দ্র)

“সারা বছর, আমফান হোক অথবা করোনা—সব সময় আমরা ইন্ডাস্ট্রির মানুষরা সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের দিকে আঙুল তোলা খুব সহজ। যারা এই কাজটা করেছেন, তা থেকেই তাদের বিকৃত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। সিপিআইএম দলটিকে তো আমি সেনসিবল ভাবতাম। ওদের যে ইয়ং জেনারেশনটা রয়েছে, তাঁদের প্রত্যেককে বিচক্ষণ ভেবেছিলাম। কিন্তু ওঁদের মদতে ওই পেজ থেকে যা করা হল, তাতে করে ওঁরা আবারও প্রমাণ করে দিল যে ওঁরা কতটা নীচে নামতে পারে! সব সময় সাহায্য করে জাহির করি না। ভূমি পেডনেকর ফোন করেছিলেন কলকাতায় তাঁর এক পরিচিতর সাহায্যের জন্য, বিদেশ থেকেও ফোন এসেছে। সব ব্যবস্থা করেছি আমি। ব্যারাকপুরে ইতিমধ্যেই সেফ হোমের ব্যবস্থা করেছি। টিটাগড়েও কাজ চলছে। এই অবস্থায় নম্বর ভাইরাল করে দেওয়ায় এত ফোন ঢুকছে যে যাঁদের সত্যি দরকার তাঁদের ফোনই ধরতে পারছি না।”

 

 

পার্নো মিত্র (বিজেপি প্রার্থী, বরাহনগর বিধানসভা কেন্দ্র)

“আমি কখনও জানিয়ে মানুষের জন্য কাজ করিনি। কাছের মানুষেরা জানেন আমফানের সময়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াব বলে কীভাবে টাকা জোগাড় করেছি। হাত অবধি পেতেছি লোকের কাছে। তা-ই আলাদা করে মানুষের জন্য কাজ করতে ভয় পাইনি কখনও। এত ফোন আসছে, কিছুজনকে সাহায্য করতে পেরেছি। কিন্তু আমি কোভিড আক্রান্ত। শরীর একেবারে ভাল নেই। তা-ও যতটুকু সম্ভব করছি।”

 

বৈশালী ডালমিয়া (বিজেপি প্রার্থী, বালি বিধানসভা কেন্দ্র)

“আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি ওঁদের উপর। আমি তো এভাবেই কাজ করছি এতগুলো বছর ধরে। আমার ফেসবুক পেজে নিজের নম্বর দিয়েছিলাম। কিন্তু কালকের পর থেকে বহু লোক আমাকে কল করেছে। দু-তিন হাজার লোক আমাকে কল করেছে। আমি সাধ্য মতো চেষ্টাও করেছি। এতগুলো বছর ধরে মানুষের জন্য অ্যাম্বুল্য়ান্স থেকে রক্ত জোগাড় করে চলেছি। এত ফোন পেয়ে ভাল লাগছে, আমি তো বলেছি আমার নম্বর সেভ করে রাখুন। দরকারে আবার কল করবেন।

 

 

কাঞ্চন মল্লিক (তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী, উত্তরপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র)

“গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত ৫০০-৭০০ টা ফোন কল পেয়েছি। হুমকি কল আসেনি কোনও> কিন্তু একাধিক মেসেজ পেয়েছি। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালির মেসেজ। এটা কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ করতে পারেন না। আমরা তো কারও বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে যাইনি। এই পরিস্থিতিতে এমন অসভ্যতা না করে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারতেন। আমি কারও মেসেজের কোনও রিপ্লাই দিইনি। যা-যা হচ্ছে তা ২ তারিখের কথা মাথায় রেখেই করা হচ্ছে। কিন্তু উত্তরপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের অনেকে মেসেজ করে লিখেছেন, “দাদা আপনার পাশে আছি। জয় বাংলা।”