ভোর থাকতেই স্নান করে স্কুল যাওয়া নেই। তেরঙ্গা হাতে নিয়ে নেই শোভাযাত্রার উন্মাদনাও। একসঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ‘জনগণমণ’তে গলা মেলানো নেই। এ এক অন্য উদযাপন। করোনা কেড়েছে স্কুল যাওয়া। পর পর দু’বছর তাই ভার্চুয়ালি স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে বিভিন্ন স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জুড়ে। এই ঠিক দু’বছর আগেও যেভাবে চলছিল, সব কিছু সে হিসেব ওলট-পালট হয়েছে বহুদিন।
স্বাধীনতা দিবসও এর ব্যতিক্রম নয়। যে শিশুটি গত বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে, সে পর পর দু’বছর স্কুলে কাটিয়ে দিলেও স্বাদ পায়নি মার্চ পাস্ট, পতাকা উত্তোলনের সেই অবর্ণনীয় উন্মাদনার। ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে স্কুলগুলিতে সকাল থেকেই স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়েছে ঠিকই, তবে তা ল্যাপটপের স্ক্রিনে, স্মার্টফোনকে সঙ্গী করে। কোনও-কোনও স্কুলে আবার শিক্ষক-শিক্ষিকারা হাজির হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে তাঁদের বাড়িতে থাকতেই বলা হয়েছে। ছোট-ছোট হাতে ক্লাস থ্রির শোভন অথবা ক্লাস সেভেনের তীর্থা বাড়িতেই এবার পতাকা উত্তোলন করেছে। ল্যাপটপের সামনে দাঁড়িয়ে গেয়েছে জাতীয় সঙ্গীত।
ওদের কি মন খারাপ? কীভাবে গোটা বিষয়টা দেখছেন তাঁদের বাবা-মায়েরা? আর কীভাবেই বা এ দিন সকাল থেকে স্কুলে-স্কুলে পালিত হল স্বাধীনতা দিবস? বাড়ি বসে স্বাধীনতা দিবস পালনে দিনটির গুরুত্ব কি আদৌ বুঝতে পারছে ওরা? TV9 বাংলা কথা বলেছিল শহর ও জেলার বেশ কিছু স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকের সঙ্গে। কথা বলেছিল মনোবিদের সঙ্গেও… কী বললেন ওঁরা? রইল…
সুনীতা দে (অধ্যক্ষ, বালিগঞ্জ শিক্ষাসদন)
‘‘পতাকা উত্তোলন পর্বটা আগেই স্কুলে আমরা রেকর্ড করে নিয়েছিলাম। সেটাই এ দিন দেখানো হয়েছে। বাকিটা ভার্চুয়ালি কম্পোজ় করা হয়েছিল… নাচ-গান মিলিয়ে প্রায় ৪০ মিনিটের অনুষ্ঠান। অনলাইন সেলিব্রেশন হলেও বাচ্চাদের মধ্যে যাতে জাতীয়তাবোধের বিকাশ হয়, সেই কারণে অনুষ্ঠানের মধ্যেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান অবস্থা, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সবটাই উল্লেখ করা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। আমাদের বাচ্চারাই কিন্তু ওটা তৈরি করেছিল, আমরা শুধু গাইড করেছি। অনলাইনে হলেও চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।’’
মলি বিশ্বাস (সহশিক্ষক, বাগবাজার মাল্টিপারপাস গার্লস স্কুল)
‘‘গত বার পুরো অনুষ্ঠানটিই ভার্চুয়াল করতে হয়েছিল। স্কুলের অনেক ছাত্রী অনলাইনে অনুষ্ঠান করেছিল। তবে এ বার সেমি-ভার্চুয়াল। মেয়েরা কেউ স্কুলে না-এলেও শিক্ষিকারা এসেছি। ১১টা নাগাদ স্কুল প্রাঙ্গণেই পতাকা উত্তোলন হয়েছে। এই অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ছোট করে পালিত হয়েছে। এ ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপে মেয়েরা সারাদিনই কিছু না কিছু করেছে।’’
প্রিয়াঙ্কা দত্ত মুখোপাধ্যায় (সেক্রেটারি, কারমেল স্কুল, বর্ধমান)
“বিগত বেশ কিছু দিন ধরেই স্কুলে আমরা শিক্ষিকারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান রেকর্ড করেছিলাম ছাত্রছাত্রীদের জন্য। এক সপ্তাহ ধরে ‘ইন্ডিপিডেন্স উইক’ পালিত হয়েছে। বাচ্চারা স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত নাচ-গান-আবৃত্তি লাইভ ভার্চুয়াল ক্লাসে পারফর্ম করেছে। এ দিন সকালে শিক্ষিকারা স্কুলে উপস্থিত হয়ে পতাকা উত্তোলনে যোগ দিয়েছিলাম। এরপর ভার্চুয়ালি প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছে। এভাবেই কেটেছে এবারের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন।”
অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় (শিক্ষক, সেন্ট অগাস্টিন)
‘‘এ বছরও সেই ভার্চুয়াল সেলিব্রেশন হয়েছে। পতাকা উত্তোলন যদিও বিদ্যালয়ে গিয়েই করা হয়েছে। বাকি অনুষ্ঠানের জন্য ভরসা জ়ুম। স্বাধীনতা দিবসের গুরত্ব যাতে বাচ্চারা বুঝতে পারে, সে দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। যেহেতু বাচ্চারা কেউ আসতে পারেনি, তাই-ই প্রত্যেকের কাছ থেকে ভিডিয়ো চেয়ে নেওয়া হয়েছিল আগেই। এ বছর প্রথমে পতাকা উত্তোলন দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের অনুষ্ঠান। জ়ুমে হাজির ছিল আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা। এর পর একে একে কবিতা-গান… কখনও আমরা আবার কখনও আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা। স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব বোঝাতে সেই কবিতা-গানও কিন্তু স্বাধীনতা নিয়েই। হার্ড ডিস্কে পোস্টার বানিয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা। পিপিটি ফাইলে সেটা দেখানো হয়েছে। লাইভ পেন্টিং করেছিলেন আমাদের এক শিক্ষক। আয়োজিত হয়েছিল কুইজ়। সেখানে এই বিশেষ দিনের পাশাপাশি প্যান্ডেমিক নিয়েও প্রশ্ন ছিল। এভাবেই পালিত হল স্বাধীনতা দিবস।’’
রূপাঞ্জনা মিত্র (অভিনেত্রী ও অভিভাবক )
‘‘দু’বছর ধরে এই সমস্যার মধ্যে আমার বাচ্চাও যাচ্ছে। ওদের সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টটা কোথাও গিয়ে বাধা পাচ্ছে। আমার বাচ্চার আট বছর বয়স। দু’বছর আগেও স্বাধীনতা দিবসের সেই গুরুত্বটা ও বোঝেনি। কিন্তু ওই যে সবাই মিলে একসঙ্গে স্কুলে অংশ নেওয়া ভিতর থেকে দেশের প্রতি একটা ভালবাসা তৈরি করে দেয়। আমরা যখন ছোট ছিলাম আমাদেরও কিন্তু স্কুল থেকেই দেশের প্রতি ভালবাসা, ইত্যাদি স্কুল থেকে এসেছে… দেশের গান, পতাকা উত্তোলন এগুলো কোথাও ভার্চুয়ালি পালন করা খানিক অন্যরকম। তবে হ্যাঁ, বাচ্চার যেহেতু এই সময় ভীষণ স্মার্ট, তাই আমার মনে হয় পাশাপাশি এই অবস্থাকেও ওরা মেনে নিয়েছে। ওকেও স্কুল থেকে বলা হয়েছিল পতাকা উত্তোলন হবে এই সময়ে জয়েন করতে… করেছে। আর দেশের প্রতি ভালবাসার যে অনুভূতি… সেটা মনে হয় এমনিই থাকবে।’’
দিয়াশ্রী দাস চক্রবর্তী (ব্যাঙ্ককর্মী ও অভিভাবক)
‘‘আমার বাচ্চার বয়স চার। গত বছর ওকে স্কুলে ভর্তি করেছি। পর পর দু’বছর ও ভার্চুয়ালি স্বাধীনতা দিবস পালন করল। আমার ছেলে দু’বছর স্কুল করে ফেলল অথচ বুঝলই না স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রকৃত অর্থ কী? কিন্তু কিছু করার নেই। এই ঘটনা তো আর চিরস্থায়ী নয়। আশা রাখছি আগামী বছর সব ঠিক হবে।’’
রিমা মুখোপাধ্যায় (মনোবিদ)
‘‘শুধু স্বাধীনতা দিবস কেন, প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে শুরু করে সব দিনগুলোই যে আর আগের মতো নেই, তা ওরা দেখছে প্রায় দু’বছর ধরে। যারা একদম ছোট বাচ্চা, সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তারা হয়তো ব্যাপারটা খুব একটা বুঝবে না। কিন্তু যারা উঁচু ক্লাসে রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় না খুব একটা সমস্যা হবে বলে। কারণ তারা জানে স্কুল যখন খুলে যাবে, তখন আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে। ভার্চুয়াল মোডেও কিন্তু অনেক কিছু হতে পারে। হ্যাঁ, মার্চ পাস্ট হয়তো করতে পারবে না। কিন্তু বাকি জিনিসগুলো যেমন নাচ-গান-কবিতা-এগুলো করাই যাবে। হ্যাঁ, মনখারাপ হতে পারে। সেটা খুব স্বাভাবিক। জিনিসগুলো মিস করছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাতে করে ওদের কোনও স্থায়ী ক্ষতি হবে মানসিক দিক দিয়ে এটা আমার মনে হয় না। যদি কোনও স্কুলে এবার স্বাধীনতা দিবস ভার্চুয়ালিও পালন না হয়ে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে বাচ্চার বাবা-মা বাড়িতে স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন বা আগের কোনও রেকর্ডিং থাকলে তা-ও বাচ্চাকে শোনাতে পারেন, যাতে করে স্কুলে না গিয়েও স্কুলের সেই ‘ভাইভ’টা সে পেতে পারে।’’
গ্রাফিক্স: অভীক দেবনাথ
তথ্য সহায়তা: সুমন মহাপাত্র