স্নেহা সেনগুপ্ত
২৫ সেপ্টেম্বর, রবিবার, মহালয়া উপলক্ষে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আয়োজিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের পরই ইন্টারনেট উপচে পড়েছে কটাক্ষে, সমালোচনায়। মা দুর্গাকে নাকি আগের মতো ‘ঠাকুর-ঠাকুর’ বলে মনে হয় না। তাঁকে দেখে নাকি ভক্তি জাগে না। বরং হাসি পায়… অর্থাৎ আগের দূরদর্শনের মা দুর্গার মতো লাগে না। এটাই বলতে চেয়েছেন সকলে। সেই সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে একদা ‘মা দুর্গা’ সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি এবং ভিডিয়ো। এসব দেখেছেন তিনি নিজেও, অর্থাৎ সংযুক্তা স্বয়ং। তাঁর মতামত আমরা জানব না? জানতে যে হবেই। তাই TV9 বাংলা খোঁজ শুরু করল: দূরদর্শনের মা দুর্গার। ফেসবুক ঘেঁটে পাওয়া গেল ‘মা দুর্গা’কে। সেই বড়-বড় টানা-টানা চোখ, শান্ত মুখশ্রী। আর সেই তেজ। জানা গেল, ‘মা’ বঙ্গে নেই—তবে বঙ্গবাসীর সঙ্গে ‘কানেক্টেড’ আছেন। উত্তর দিলেন সুদূর কানাডা থেকে। ভোর ৬টায়। তারপর চলল দীর্ঘ কথোপকথন…
২০১২ সাল থেকে কানাডার টরোন্টো-অন্ট্যারিওতে আছেন সংযুক্তা। তার আগে বেশ কিছু বছর ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিয়ের পর ওদেশে পাড়ি দেন। তারপর পাকাপাকিভাবে থেকে গিয়েছেন, আর কলকাতায় ফেরেননি। বিবাহ সূত্রে বিদেশকেই আপন করে নিয়েছেন ‘দূরদর্শনের মা দুর্গা’। স্বামী তাঁর বিজ্ঞানী। সংযুক্তা নিজে মোহিনীঅট্টমে পিএচডি করেছেন। নৃত্য় প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী তাঁর। ভাবতেও অবাক লাগে, সাত সমুদ্দূর তেরো নদী পেরিয়ে অসুরদলনী আজ নাচের দিদিমণি। গুরুপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন সেখানেই। ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তার করছেন ভিনদেশেও। মা তা হলে সর্বত্র। সব রূপেই বিরাজমান…
কী কথা হল সংযুক্তা ‘দুর্গা’ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে?
প্রশ্ন: ইন্টারনেটের কথা আপনি নিজেই তুললেন। তা হলে এখান থেকেই সরাসরি প্রশ্নে ঢুকে যাওয়া যাক। জানেন কি, আপনি এখন ইন্টারনেটে সেনসেশন?
আসলে দীর্ঘদিন ধরে দেখতে-দেখতে মানুষের মনে একটা ছবি গেঁথে গিয়েছে। তখন দূরদর্শনেরই রমরমা ছিল। সেরকম বিকল্প তো ছিল না। পরবর্তীকালে প্রাইভেট চ্যানেলের রমরমা শুরু হয়। এটা আমার কাছে খুবই Inspiring যে, একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে, একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে, এত চ্যানেলে (ইউটিউব প্রাইভেট চ্যানেলেও) এত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র অনুষ্ঠান হচ্ছে। গুনে শেষ করা যাবে না। তা-ই হয়তো মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাও বেড়ে যাচ্ছে। সব ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র অনুষ্ঠান আমি দেখে উঠতে পারিনি। যেগুলো দেখেছি, বারবারই মনে হয়েছে Simplicity-র বড়ই অভাব। শুধু তাই-ই নয়, Divinity-রও অভাব বোধ করেছি। মনে হচ্ছে, এই দু’টোই মারাত্মকভাবে Compromised। এত বেশি প্রাচুর্য্যে ভরা যে, ‘মা দুর্গা’কেই দেখা যাচ্ছে না ভারী-ভারী গয়নার কারণে। অসুরকে মারার আগে অসুরও অসম্ভব নাচানাচি করছে। কিন্তু কেন? একজন শিল্পী হিসেবে অনেকবছর আগে আমি একটা কাজ করেছিলাম। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেয়েছিলাম। সেইটার একটা Representative Face তৈরি হয়েছে। একটা নিদর্শন তৈরি হয়েছে। সেটা একজন শিল্পী হিসেবে আমার কাছে মস্ত বড় পাওয়া। আমার একার কৃতিত্বও তো ছিল না। সকলে মিলে আমরা কাজটা করেছিলাম।
প্রশ্ন: আপনার ফেসবুক ঘাঁটছিলাম, সেখানে আপনি যাঁদের রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করেছেন, তাঁরা লিখেছেন, ‘এবারের পুজোয় মা দুর্গা আমার ফ্রেন্ড’! বিষয়টা আপনার কীরকম লাগে?
আমি খুব একটা ফেসবুক করি না। আমার পেজ আছে ঠিকই। অনেকেই রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। আমি অ্যাক্সেপ্ট করতে পারিনি। নাচের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, তাঁদেরটা করেছি। অনেকেই সৌজন্যবশত লিখেছেন এসব কথা।
প্রশ্ন: ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র শুটিংয়ের দিনগুলো কীরকম ছিল?
আমাদের ওয়ার্কশপ হত। পরিচালক থাকতেন সেখানে। সবটাই রিহার্স করা হত। ডান্স এবং থিয়েটারের মিশেলে যেহেতু সবটা হত, তাই খুব সিরিয়াসলি ওয়ার্কশপ হত। তারপর হত শুটিং।
প্রশ্ন: তখন তো এত ভিএফএক্স কিংবা গ্র্যাফিক্সের কাজও হত না…
আমাদের সময় ‘নব-দুর্গা’ হয়েছিল। দেবীর কত রূপ… কত সাজসজ্জা… এখনও হচ্ছে। কিন্তু আগের মতো নয়। এখন নিজেদের মতো তৈরি করে নিচ্ছেন সকলে। চণ্ডী এবং পূরাণ থেকে বিষয়টা অনেকটা সরে গিয়েছে। সহজ কথায় বলতে গেলে, গোটা বিষয়টাই অতিরঞ্জিত হয়ে গিয়েছে। আমার প্রধান প্রশ্ন হল: এই পূরাণ আর চণ্ডীর গল্পগুলোকে নিজেদের মতো করে Interpret করলে পরবর্তী প্রজন্ম কী শিখবে, কী জানবে? এই কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? আমরা কি এখন কার্টুন দেখছি? এগুলো কিন্তু আমার কথা নয়। আমাদের এখানে যে বাচ্চারা এখনকার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ দেখছে, তারাই বলছে এমন কথা। তাদের মনেও প্রশ্ন জাগছে: ‘‘মৃত্যুর আগে মহিষাসুর এরকমভাবে নৃত্য করছে কেন? সে কি ভীত নয়?’’ আমি একটা কথাই বলব, যাঁরা এই অনুষ্ঠানগুলো তৈরি করছেন, দয়া করে ভেবে করুন। তাঁদের কাছে প্রচুর Resource। তাঁরা চাইলেই ভাল অনুষ্ঠান করতে পারেন। আমাদের সময় এ সমস্ত কিছুই ছিল না। আমাদের সময় এত গ্র্যাফিক্সের কাজও ছিল না।