Women’s Day 2022: আমি পেশাগতভাবে ডিজে… মিউজিক বাজাই, বেলেল্লাপনা করি না
Women's Day 2022: ডিজে (Female DJ) হতে গেলে কিন্তু খুঁটিনাটি অনেক কিছু শিখতে হয়। রীতিমতো পড়াশোনা, চর্চা লাগে। বিষয়টা একদমই ছেলেখেলা নয়। হাতেকলমে শিখে পটু না হলে ডিজে (DJ) হওয়া যায় না।
যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে…
শুধু চুল কেন, একুশ শতকের মেয়েরা আরও অনেক কিছুই করেন। ল্যান্সডাউনের নীলাশ্রী চৌধুরী রাতের কলকাতা শহরকে রীতিমতো নিজের ছন্দে মাতিয়ে রাখেন। টিনএজার থেকে চল্লিশোর্ধ, নীলাশ্রীর তালে নাচতে পছন্দ করেন সকলেই। পেশায় নীলাশ্রী ডিস্ক জকি, যাকে বলে মহিলা ডিজে। কলকাতার অসংখ্য নাইট ক্লাব, পাবে দাপিয়ে শো করেন তিনি। সেয়ানে-সেয়ানে টক্কর দেন পুরুষশাসিত এই পেশায় থাকা অন্যান্য ডিজেকে।
একুশ শতকেও মহিলা ডিজে শুনে অনেকেই নাক সিঁটাকাচ্ছেন তো? নীলাশ্রীর কেরিয়ারের শুরুতেও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। তবে আত্মবিশ্বাসের জোরে ঘনিষ্ঠজনদের পেশা এবং প্যাশন সম্পর্কে বোঝাতে সফল হয়েছেন তিনি। তবে এখনও কোথায় যেন সামান্য হতাশা রয়েছে। TV9 বাংলার সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে তাই বলেই ফেললেন, “কত জনের মনোভাব আর বদলাবো? তবে ভাল লাগে এটাই যে, অনেকে আজকাল বুঝতে শিখেছেন।”
কেমন ছিল নীলাশ্রীর জার্নি? কেনই বা বেছে নিলেন এমন ‘আউট অফ দ্য বক্স’ পেশা? নারীদিবসে সেইসব নিয়েই TV9 বাংলার সঙ্গে আড্ডা দিলেন নীলাশ্রী চৌধুরী। নিজেকে মহিলা ডিজে ট্যাগ দিতে অবশ্য বেশ আপত্তি রয়েছে নীলাশ্রীর। তাঁর কথায়, “ডিজে একজন পারফর্মার। তিনি মহিলা হোন বা পুরুষ। পারফরম্যান্সটাই আসল কথা। লোকেরও সেটাই মনে রাখা উচিত।”
কত বছরের কেরিয়ার আপনার?
আট বছর ধরে এই পেশায় রয়েছি। আমি কিন্তু অন্য চাকরিও করি। দিনে অফিস যাই। এখন একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে রয়েছি। আর রাতে ডিস্কো, নাইট ক্লাব, পাবে যাই শো করতে। সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততায় কাটে। তবে খুব উপভোগ করি। যাই-ই হোক না কেন, আমার কাছে ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’।
হঠাৎ ডিজে কেন?
আমি অনেক অল্প বয়স থেকেই কাজ করা শুরু করেছি। ডিজেয়িং- এর প্রতি আগ্রহ বিভিন্ন ক্লাবে যাওয়ার পর থেকেই। আসলে লোকে ডিস্কে গিয়ে নাচত। আমি গিয়ে ডিজেদের দেখতাম। খুব আগ্রহ হত কীভাবে মিউজ়িক মিক্সিং হয়, কোন ট্র্যাকের সঙ্গে কোন গান ভাল লাগবে শুনতে, এই নিয়েই আগ্রহ ছিল। গান ভালবাসি সবসময়ই। সেই থেকেই ইচ্ছে হয়েছিল ডিজে হব। কোনওদিন এভাবে ভাবিনি যে ডিজে তো ছেলেরা হয়। আমি কি আদৌ পারব… বরং সবসময়েই মনে হয়েছিল এটা অন্যরকমের পেশা। আমার এটা ভাল লাগছে। ডিজে মিউজ়িক শুনতে ভাল লাগে। নিজে ট্র্যাক তৈরি করতে পারলে আরও ভাললাগবে।
তারপর…
আমি প্র্যাট মেমোরিয়ালের ছাত্রী। স্কুল শেষের পর থেকেই চাকরি করা শুরু করেছি। বাকি পড়াশোনা করেছি ডিসট্যান্সে। প্রথমে টুকটাক চাকরি করতাম। ডিজে হব হুজুগ চাপার পর থেকে খোঁজ নেওয়া শুরু করি যে এর জন্য কী করতে হবে। জানতে পারি এর জন্য ঠিকমতো কোর্স করতে হয়। অনেকে হয়তো জানেন না ডিজে হতে গেলে কিন্তু খুঁটিনাটি অনেক কিছু শিখতে হয়। রীতিমতো পড়াশোনা, চর্চা লাগে। বিষয়টা একদমই ছেলেখেলা নয়। অনেকেই ভাবেন ডিজে হওয়া আর এমন কী… এর মধ্যে অনেক জটিলতা রয়েছে। হাতেকলমে শিখে পটু না হলে ডিজে হওয়া যায় না।
আপনি কোথায় শিখেছেন?
নিউ আলিপুরের কাসাব্ল্যাঙ্কা স্টুডিয়োতে শিখেছি আমি। আসলে শেখার আগে আমি অনেকদিন এই ‘ডিজেয়িং’ বিষয়টা নিয়ে চর্চা করেছি। সেই সময়ে রেডিয়ো ওয়ানে আরজে হিসেবে ইন্টার্নশিপ করেছি। তখন থেকেই ডিজে মিউজ়িক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। বিভিন্ন ক্লাবে যেতাম, একদমই পার্টি করতে নয়, বরং ডিজেরা কী করে, কীভাবে করে, সেই সব দেখতে। তখন থেকেই ধীরে-ধীরে এই পেশাকে কেন্দ্র করে আগ্রহ জন্মায়। বুঝতে পারি এটা আমার ভাল লাগার জায়গা। কিন্তু তখন জানতাম না যে এটা কীভাবে করে। তারপর জানতে পারি কোর্সের কথা, যেটা বেশ খরচসাপেক্ষ। একসঙ্গে অত টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। তবে এ ব্যাপারে আমার ট্রেনার ডিজে রাজ রায় আমায় প্রচুর সাহায্য করেছেন। ধীরে-ধীরে টাকা জমিয়ে আসতে আসতে টাকা দিয়েছিলাম আমি। তখন অফিস করে রাতে ক্লাস করতে যেতাম। প্রাথমিকভাবে শেখার পর বিভিন্ন সিনিয়রদের শোতে অ্যাসিস্ট করতাম।
কেরিয়ারের শুরুটা কেমন ছিল আপনার?
বেশ কষ্টকর। অফিস করে শিখতে যাওয়া, তারপর অফিস করে শো করতে যাওয়া… এমনও হয়েছে অফিস করে বেরিয়ে ট্রেন ধরে বাইরে শো করতে গিয়েছি, পরদিন ফিরে অফিস জয়েন করেছি… টানা ২-৩ দিন প্রায় ঘুমোইনি। শরীরে ভীষণ ধকল যেত। মনে হচ্ছিল আর টানতে পারব না। সব ছেড়ে দিই। কিন্তু তারপর নিজেই নিজেকে মোটিভেট করেছি। নিজেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে বুঝিয়েছি এত কষ্ট করে শিখতে যখন পেরেছি, তখন বাকিটাও পারব। পথ হয়তো মসৃণ হবে না, কিন্তু আমি পারব, পারতে আমাকে হবেই।
একে মেয়ে, তায় ডিজে, রাতে শো, আরও রাতে বাড়ি ফেরা… বাড়ি-পাড়া-এক্সটেনডেড ফ্যামিলি… সমস্যা হয়নি?
প্রচুর… প্রচুর… প্রচুর… ওসব বলে শেষ করা যাবে না। ইনফ্যাক্ট এখনও হয়। তবে আগে ওসব নিয়ে ভাবতাম। মন খারাপ হত। এখন আর কষ্ট পাই না। নিজের পরিবারকে বোঝাতে পেরেছি। আমার মা-বাবা, দিদি সবাই সাপোর্ট করে। ওরা বুঝতে পেরেছে যে আমি ঠিক কী কাজ করি। আমি পেশাগতভাবে ডিজে। ক্লাবে মিউজিক বাজাই। বেলেল্লাপনা করি না। আক্ষরিক অর্থে ওটা একটা কাজ। নিজের লোকেরা বুঝেছে, সাপোর্ট করে। ব্যাস, আর কী চাই। আর আমি বিশ্বাস করি নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকলে, কাজকে ভালবেসে করলে হাজার বাধা এলেও সফল আমি হবই। নিজের জীবন দিয়ে এটা আমি বুঝেছি। খানিকটা পারিবারিক সমস্যার কারণেই অনেক অল্প বয়স থেকে রোজগার করা শুরু করেছিলাম। তারপর নিজের জন্য একদম ‘হটকে’ একটা পেশা বেছে নিয়েছি। আট বছর ধরে রয়েছি এই ফিল্ডে। প্রচুর ওঠানামা, চরাই-উতরাই দেখেছি। নিজের শো পেতেও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। ডিজেয়িং শেখার পর নিয়মিত চর্চা করেছি। নিজের ট্র্যাক মিক্সিং বানিয়েছি। সময় লেগেছে বড় সুযোগ পেতে। কিন্তু পেয়েছি। কিছুটা সফল হয়েছি। আগামী দিনে আরও অনেকটা সাফল্য অপেক্ষা করছে এই আশাই রাখি।
কী ধরনের শো সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেন?
সব শো-ই সমান। প্রতিটা শোতেই আমি আমার ১০০ শতাংশ দিয়ে পারফর্ম করি। অডিয়েন্স বুঝে ট্র্যাক মিক্সিং এবং প্লে করাটাই আসল খেলা। তবে সবকিছুর মধ্যে এখনও সবচেয়ে বেশি এনজয় করি কলেজ ফেস্ট। প্রচুর খাটনি কিন্তু। সারারাত বাজিয়েছি, এমন অভিজ্ঞতাও আছে। তা-ও ওটাই ভাল লাগে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ ক্যামেরা কনশাস। তাই নিউজ় রিডার হওয়ার একসময় ইচ্ছে জেগেছিল। কিন্তু বুঝেছিলাম ওটা হবে না আমার দ্বারা। মানে কাজ পারলেও ক্যামেরার মুখোমুখি হতেই সমস্যা হবে। এখনও শোয়ের সময় কেউ ছবি তুলতে চাইলে আগাম বলে দিই আমায় ডেকে পোজ় দিতে বলো না। নিজেদের ইচ্ছেমতো তুলে নাও। ‘ক্যান্ডিড’ ছবিতেই আমার স্বচ্ছন্দ্য। আমার খুব স্টেজ ফোবিয়াও ছিল। এখন অবশ্য সামনে যত বেশি লোক থাকে, নিজে তত বেশি উৎসাহ পাই। ওইজন্যই কলেজ ক্রাউড, কলেজ ফেস্ট আমার কাছে সেরা।
ডিজেয়িং মানে মেল ডমিনেটেড প্রফেশন, কখনও মনে হয়েছে এর জন্য কম সুযোগ পেয়েছেন?
নাহ্। বরং আমার আট বছরের কেরিয়ারে অভিজ্ঞতা কিন্তু বেশ ভাল। আসলে বাইরে থেকে হয়তো মনে হয় যে ডিজে মানেই ছেলে হবে। বিষয়টা আসলে কে ভাল পারফর্মার। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তাঁর পারফরম্যান্সই আসল। আর আজকাল কিন্তু ছেলেদের তুলনায় মেয়ে ডিজেদের রমরমা বেশি। এর একটা কারণ অতি অবশ্যই গ্ল্যামার। তবে হ্যাঁ, যদি পারফরম্যান্স ভাল না হয়, তাহলে আজ বাদে কাল কেউ আর ডাকবে না।
তরুণ প্রজন্মের যেসব মেয়েরা ডিজে হতে চায়, তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন?
এই ইচ্ছেটাই এমন যে লোকে বুঝবে না প্রথমে। তাই হয়তো ভয়েই অনেকে বলবে না। তবে আমি বলব যদি নিজের প্যাশনের ব্যাপারে কেউ আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে এগিয়ে যাও। আর ডিজে হতে চাইলে আগে টেকনিক্যালি পড়াশোনা করো। শেখো। জিনিসটা বোঝো। তারপর ফিল্ডে আসো। কারণ তুমি কী করো সেটা কাউকে বোঝানোর আগে তোমার নিজের ভাল করে জানা প্রয়োজন। ডিজে হতে গেলে কিন্তু অসীম ধৈর্য্য দরকার। সাফল্য আসতে সময় লাগবে। কেরিয়ারে প্রচুর ওঠানামা দেখতে হবে। নিজের প্রিয়জনদের সঙ্গে মানসিক লড়াই লড়তে হবে। এমনকি অডিয়েন্স হ্যান্ডেল করাও শিখতে হবে। কারণ ভাল-খারাপ মানুষ মিলিয়েই জগৎ। তুমি কাকে কীভাবে হ্যান্ডেল করবে, সেটা তোমার ব্যাপার। বাইরে থেকে ডিজেয়িং ব্যাপারটায় যতটা চাকচিক্য আছে, পথ কিন্তু ঠিক ততটাই বন্ধুর। তাই নিজের উপর কতটা বিশ্বাস আছে, সেটা বোঝা সবচেয়ে জরুরি।
গ্রাফিক্স ও অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস