Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Sandhya Mukhopadhyay Obituary: তীর বেঁধা পাখি আর গাইবে না গান

আমাদের মনে জলন্ত আগ্নেয়গিরির এক তীব্র স্ফুলিঙ্গ হয়েই থেকে যাবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তিনিই শিখিয়ে গেলেন কীভাবে শিরদাঁড়া সোজা রাখতে হয়।

Sandhya Mukhopadhyay Obituary: তীর বেঁধা পাখি আর গাইবে না গান
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Feb 15, 2022 | 8:13 PM

২০২২-এর জানুয়ারি মাস। ২৫শের সন্ধ্যা। নাকি ‘সন্ধ্যা’র নব আগমনী। এই একটি মাত্র সন্ধ্যায় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন কিংবদন্তি। চারদিকে কেবলই হইচই। নাকি ‘পদ্মশ্রী’ পেতে চলেছেন ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায়। সটান নাকচ করে দিলেন বলিষ্ঠমনা। ‘পদ্ম’ কমিটিকে স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিলেন: ‘মেরা দিল নেহি চাহতা হ্যায়, ম্যায় নেহি লুঙ্গি!’ ৯০তে এসে মানুষের স্মৃতি হারিয়ে যায়। তা হলে কোন মনোবলে এমন সিদ্ধান্ত ‘গীতশ্রী’র? ব্রিটিশ আমলের পুলিশ কর্মকর্তার নাতনি বলেই কি এহেন সিদ্ধান্ত? সেই কারণেই কি ‘ইন্দ্রধনু’র তীরে বিদ্ধ করতে পারেন এত সহজে? চলে যেতে-যেতে সন্ধ্যার অস্ফুট বার্তা: ‘শিরদাঁড়াটা এখনও সোজাই আছে!’

১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় রেলকর্মী নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্য়ায় ও হেমপ্রভা দেবীর ঘর আলো করে জন্মেছিলেন বঙ্গরত্না। ৬ ভাই-বোন। তাঁদের অনুজ সন্ধ্যা। ঠাকুরদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের বড় পুলিশ অফিসার। ছোট থেকেই সুর ছিল গলায়। কণ্ঠে ছিল কুহুতানের মিষ্টত্ব। নরেন্দ্রনাথই ঠিক করেন মেয়েকে গান শেখাবেন। সেই থেকে প্রশিক্ষণ শুরু।

১২-১৩ বছর বয়স থেকে গান গাইতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্য়ায়। সঙ্গীতে তালিম শুরু পণ্ডিত সন্তোষকুমার বসুর হাতে। তারপর গানকেই ধ্যানজ্ঞান করে তেলেন ঢাকুরিয়ার মেয়েটি। অধ্যাপক এ টি কানন, অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীরা হাতে ধরে ‘সা রে গা মা’ শিখিয়েছিলেন সন্ধ্যাকে। তারপর গুরুরালয়ে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানকে পেলেন গুরু হিসেবে। পরবর্তীতে ওস্তাদজির পুত্র ওস্তাদ মুনাওয়ার আলি খানের কাছে প্রশিক্ষিত হলেন সন্ধ্যা। বিশেজ্ঞরা চিরকাল স্বীকার করেছেন, অসংখ্য, অজস্র ছবির গান গাওয়ার পরও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে দূরে সরিয়ে রাখেননি শিল্পী।

বাঙালি শিল্পীদের প্লেব্যাক সারা দেশে সমাদৃত। আজ থেকে নয়। বহুযুগ ধরে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শিকতা এক দিকে, অন্যদিকে প্লে ব্যাক। কেরিয়ারের শুরুতে চলে গিয়েছিলেন মুম্বই। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে প্লে ব্যাক করেছিলেন। ১৯৫০-এ সন্ধ্যা যখন ২১ বছরের তরুণী, ‘তরানা’ ছবিতে একটি গান গেয়েছিলেন। তারও আগে ১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জনগঢ়’ ছবিতে আর সি বরালের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘অব নেহি ধারত ধির ধির’ ও রবিন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত নির্দেশনায় ‘অ্যায় মেরে জীবন কি সাঁঞ্ঝ সুহানি’, ‘দিল ভি উদাস চমন ভি উদাস’ গানে মন ভরিয়েছিলেন সন্ধ্যা। ১৭টি হিন্দি ছবিতে গানের মাধ্যমে জানান দিয়েছিলেন তাঁর রামধনুসম উপস্থিতি।

১৯৫২ সালে ঘটে যাওয়া ব্যক্তিজীবনের দোলাচলে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। তারপর আবারও হিন্দি ছবির জন্য গান গেয়েছেন। ‘আ গুপ চুপ গুপ চুপ পেয়ার করেঁ’, ‘তোসে নয়না লাগে সাওয়ারিয়াঁ’ গাইতে থাকেন, গাইতেই থাকেন। মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে ওঠে গোটা দেশ।

১৯৬৬ সালে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন সন্ধ্যা। স্বামী হিসেবে পান বাঙালি কবি শ্যামল গুপ্তকে। সন্ধ্যার বহু গানের কথা লিখেছিলেন শ্যামল। তবে যে বাঙালি সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গে শ’য়ে শ’য়ে ডুয়েট গেয়ে বাঙালির হৃদয় অতলে পাকাপাকি বসবাস শুরু করেছিলেন, তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার জুটির অধিকাংশ গানের গলাই সন্ধ্যা-হেমন্তর। একে-একে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘কে তুমি আমারে ডাকো’, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’, ‘চম্পা চামেলি’র মতো গান মন ছুঁতে শুরু করে শ্রোতা-দর্শকের।

সলিল চৌধুরীর প্রিয় শিল্পী ছিলেন সন্ধ্যা। সলিলের সঙ্গীত নির্দেশনায় ‘গুনগুন মন ভ্রমরা’, ‘যা রে ফিরে যা’, ‘জীবনে যা কিছু ছিল’, ‘কিছু আর কহিব না’, ‘ও নীল নীল পায়রা’ গেয়েছেন সন্ধ্যা। কেবল হেমন্ত-সলিল নন, রবীন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গেও সন্ধ্যার গানের জুটি ছিল সুপার-ডুপার হিট।

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময় উদ্বাস্তুদের জন্য মন কাঁদত সন্ধ্যার। গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হাজার-হাজার রিফিউজির জন্য অর্থ জোগাড় করেছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গীত শিল্পী সমর দাসকে সহযোগিতা করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, বাংলাদেশের সেই সময়কার রেডিয়ো স্টেশন। যার মারফত লাগাতার দেশাত্মবোধক গান রেকর্ড করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের জেলমুক্তির পর গান বেঁধেছিলেন সন্ধ্যা ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’। এ বাংলা, ও বাংলা – দুই বাংলায় তফাৎ করেননি কোনওদিন। বাংলাদেশও কি কখনও ভুলতে পারবে তাঁর আদরের কোকিলকণ্ঠীকে? দুই বাংলার শৈল্পিক বন্ধুত্ব যখন গোড়ার দিকে নতুন আশার আলো দেখছে, প্রথম বিদেশি হয়ে সেখানকার খোলা মাঠে কনসার্ট করেছিলেন ঢাকুরিয়ার মেয়েটি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধনীতার পর পল্টন ময়দানে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছিলেন সন্ধ্যাই।

স্বাধীনতা, আত্মসম্মানবোধ কোনওদিনও পিছু ছাড়েনি যে শিল্পীর, তিনিই তো পারেন মৃত্যুর এক দিন আগে ফিরিয়ে দিতে জাতীয় সম্মান। যে সম্মান আদায়ের বয়স পার করেছে ৯০টি বসন্ত। তিনিই তো পারেন, অবলীলায় বলতে, ‘মেরা দিল নেহি চাহতা হ্যায়, ম্যায় নেহি লুঙ্গি’। আসলে এ প্রত্যাখ্যান তিনি করেননি। করেছেন তাঁর অগুনতি অনুরাগী। তাঁদেরই ভালবাসায় বেঁচে শিল্পী, গান ছাড়ার ১৭ বছর পরও। আরও ১০০ বছর বেঁচে থাকবেন। যিনি যেতে-যেতে বলে গিয়েছেন, “আমার দেশ আমাকে ভালবাসে। ২০০৩ সালে গান ছেড়েছি। এটাই আমার সাধনা। এই নিয়েই আমি থেকেছি। কোনও কিছুর দিকে তাকাইনি। পদ্মশ্রী নেওয়ার কথা জীবনেও ভাবিনি। আমার দেশ আমাকে যা ভালবাসে, সেখানে পদ্মশ্রী হোক আর যে শ্রী-ই হোক, আমার কিছুই লাগবে না। দেশের মানুষ আমাকে যে ভালবাসা দিয়েছে, সেখানে আমি আর কিছুই দেখি না।”

আপনিও আমাদের মনে জলন্ত আগ্নেয়গিরির এক তীব্র স্ফুলিঙ্গ হয়েই থেকে যাবেন। সত্যি! আপনিই শিখিয়ে গেলেন কীভাবে শিরদাঁড়া সোজা রেখে যেতে হয়।