শর্মিষ্ঠা মাইতি-রাজদীপ পাল, বর্তমানে বাংলার বুকে চর্চিত নাম। কারণ এই জুটিই বাংলার ঝুলিতে এনে দিয়েছে আরও এক জাতীয় পুরস্কার। ছবি কালকক্ষ, যা একটা সময় মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন ছবির প্রযোজক অঞ্জন বসু। শত অনুরোধেও প্রেক্ষাগৃহে শো পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে জাতীয় পুরস্কার পেতেই রাতারাতি খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের পরিচালনায় “মনপতঙ্গ” এবার মুক্তির অপেক্ষায়। তবে এবারও ছবিটা খয়ুব একটা পাল্টাতে দেখা যাচ্ছে না। তাই প্রযোজক অঞ্জন বসু আর ঝুঁকি না নিয়ে নেমে পড়লেন পথে। পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন ধর্মতলার মোড়ে। মানুষকে অনুরোধ করলেন ছবিটা দেখার জন্য। ছবির ব্যবসাকে সঠিক পথে আনার জন্য মরিয়া অঞ্জনবাবু। চেষ্টা করে চলেছেন যাতে নতুনদেরও কাজ দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। TV9 বাংলাকে তেমনটাই জানালেন অরোরা ফিল্মস-এর বর্তমান কর্ণধার অঞ্জন বসু (তৃতীয় প্রজন্ম)।
জাতীয় পুরস্কার ঝুলিতে, তারপরও রাস্তা নামছেন ছবির প্রচারে?
রাস্তায় নামতে হচ্ছে, কারণ দর্শকের কাছে অনুরোধ করতে, আবেদন করতে, প্রয়োজনে পায়ে ধরতে। একটু যদি ‘মনপতঙ্গ’ ছবিটা দেখেন তাঁরা। সিনেমাটা তো খামখেয়ালির জায়গা হতে পারে না। এটা তো একটা ব্যবসা। কত মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে এই পেশার সঙ্গে। তাঁরা কোথায় যাবেন? এখন যাঁরা প্রযোজনা করছেন, তাঁরা কি প্রকৃত অর্থে প্রযোজক! আমি কয়েকজনকে বাদ দিয়েই বলছি। আশা করি পাঠক বুঝতে পারবেন। অনেকেই আছেন অনেক টাকা ঢালতে পারছেন। কিন্তু সেই টাকার উৎস কী? একটা কথা বলুন, ৪ টাকার জিনিস ১৬ টাকায় বিক্রি করলে কে কিনবে? এটাই তো বাংলার ছবির বর্তমান অবস্থা। সেই জায়গা থেকেই পথে নামার সিদ্ধান্ত। আমি সবাইকে অনুরোধ করব, ছবিটা যেন তাঁরা দেখতে আসেন। ঠিক-ভুল, ভাল খারাপ তাঁরা বিচার করুক। তাঁরাই তো বিচারক। সেখানে কোনও মিথ্যের প্রলেপ থাকে না। আমি খুব কষ্ট থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পথে নামব। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলব। লোকে দেখুক একজন বৃদ্ধ কেন ছবির পোস্টার হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। যন্ত্রণার কথাটা তাঁদের কান পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। নয়তো তাঁরা শুধুই যে সাকসেস পার্টি দেখছেন। এটা যে সবক্ষেত্রে সত্যি নয়।
কথায় বলে স্টারেরা থাকা মানেই ছবি হিট। আপনার ছবিতে তো এখনও নতুনদের জন্য দরজা খোলা, এক্ষেত্রে কি প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যায় না?
তাহলে নতুনরা কোথায় যাবে? নতুন-নতুন কাজ কীভাবে আসবে? অরোরা আজ প্রথম নয়, অতীতেও এই কাজ করে এসেছে। নয়তো ‘পথের পাঁচালী’ হত না, সত্যজিৎ রায় হতেন না। আমাার দাদু অনাদিনাথ বসু সেই বিশ্বাসটা দেখিয়েছিলেন। আমাদের প্রযোজনা সংস্থার একটা আভিজাত্য রয়েছে। নতুনদের সুযোগ না দিলে ‘কালকক্ষ’ হত? আমি ওদের ওপর বিশ্বাস না রাখলে জাতীয় পুরস্কার আসত? স্টার থাকা মানেই ছবি হিট, সে যুগ গিয়েছে। মানুষ এখন ভাল ছবির খোঁজ করছেন। বার বার ঠকছে। যে ছবিতে সেই স্বাদ পাচ্ছে, সেটাকে সত্যি ভালবাসা দিচ্ছেন। কিন্তু আমার তো লোক দেখানোর সেই সম্বল নেই। তাই পথে নামা। ভাল ছবিটা তৈরি করাই উদ্দেশ্য, বিগ-বাজেট, বিগ স্টার তো সবাই করছেন। আমি একটু অন্য ধারার ছবির কথা বলি। কোনও একদিন আবারও সিনেপাড়া জ্বলজ্বল করবে। তখন সকলে মনে করবেন, এই মানুষটা চেষ্টা করে গিয়েছিলেন।
এক প্রযোজককে এভাবে পথে নামতে কি অতীতে দেখা গিয়েছে?
কেন? প্রযোজকের টাকাটা টাকা নয়? একবার ক্ষতি, দুবার ক্ষতি, তিনবার ক্ষতি। তারপর? ছবি করা ছেড়ে দেবেন তিনি? একটা ছবিকে কেন্দ্র করে সকলের রোজগার নির্ভর করে। তাই প্রতিটা সদস্যের উচিত কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াই করার। ছবি বানিয়ে ফেললাম, তারপর সেটা চলল কি চলল না, পরিচালক, অভিনেতাদের কোনও মাথাব্যথাই নেই, এটা হয়? অন্ততপক্ষে সৎ উপায় রোজগারের টাকায় অন্তত হয় না। আমি শুধু চাই মানুষকে ভাল ছবি উপহার দিতে। দর্শকদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়, ১৫ থেকে ৩০, ৩০ থেকে ৫০ আর ৫০-এর ওপরে। এই ৫০-এর ওপরে থাকা মানুষগুলো কিন্তু ওটিটিতে নেই। তাঁরা এখনও ভাল বাংলা ছবির খোঁজ করেন, তাঁদের ফেরাতে চাই আমি। প্রয়োজনে স্টুডিয়ো সিস্টেমকে ফেরাতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিতে সমবন্টনে কাজ হতে হবে। নয়তো একটা বড় ব্যবসা বসে যাবে। কঠিন পরিস্থিতি। ভাবতে পারছেন এখানে বাংলা ছবি চলছে না, অথচ সেই বাজারেই তো হিন্দি ছবি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মানে দর্শক আছে। তাঁরা কেন বাংলা ছবি দেখছেন না, সেই কারণটাও তো খোঁজার দরকার আছে। নতুন প্রতিভাদের জায়গা করে দিতে হবে। কাজের সুযোগ দিতে হবে। সকলের জন্য দরজা খোলা রাখতে হবে। আমরা রেখেছি। মনে রাখবেন, মনপতঙ্গ উপলক্ষ্য মাত্র, আমার স্বপ্ন গোটা বাংলা ছবির দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে ফেরানো। স্বর্ণযুগ ফেরানো। টলিপাড়া রাত দিন আলো জ্বলবে, কাজ করবেন সকলে হাসি মুখে, তাঁদের সংসার চলবে, মানুষ সঠিক বিনোদন পাবেন, আসবে, সেই আশা নিয়েই তো পথে নামা।